হযরত
জুনায়েদ বাগদাদী (রহঃ)
ছেলেবেলা হতেই
জুনায়েদ অত্যন্ত সাবধান,
তীক্ষ্ম-বুদ্ধিমান এবং আল্লাহ্
প্রেমিক ছিলেন। একবার
বাল্যকালে জুনায়েদ মাদ্রাসা
হতে ঘরে ফিরছিলেন,
পথে দেখলেন তাঁর
পিতা কাঁদছেন। কারণ
জিজ্ঞেস করলে তাঁর
পিতা বললেন, “আমি
আজ কিছু যাকাতের
মাল তোমার মামা
সররীর কাছে পাছিয়েছিলাম,
কিন্তু তিনি তা
গ্রহন করেন নি।
আমি এজন্য কাঁদছি।
কারণ আমি সারাজীবনে
এই পাঁচ হাজার
দিরহাম হালাল উপায়ে
রোযগার করেছি। তবুও
তোমার মামা এ
হালাল দিরহামের পাঁচটি
দিরহামকেও পছন্দ করলেন
না এবং তা
প্রত্যাখ্যান করলেন”। একথা
শুনে জুনায়েদ বললেন,
“আব্বা, এগুলো আমাকে
দিন, আমি এখনই
মামাকে দিয়ে আসব”।
তারপর তিনি এই
মুদ্রাগুলো নিয়ে মামা
সররীর দরজায় উপস্থিত
হলেন। দরজা বন্ধ
দেখে শিকল ধরে
টানলেন। হযরত সররী
সকতী (রহঃ) জিজ্ঞেস করলেন,
“কে ?” উত্তরে বললেন,
“আমি জুনায়দ, দরজা খুলুন এবং
এই যাকাতের দিরহামগুলি
রেখে দিন”। হযরত
সররী বললেন, “অামি
এই যাকাতের মাল
রাখব না”। জুনায়েদ
বললেন, “সেই আল্লাহ্র
কসম দিয়ে বলছি,
যিনি আপনার প্রতি
অনুগ্রহ এবং আমার
আব্বার প্রতি ন্যায়
বিচার করেছেন”। সররী (রহঃ)
বললেন, “হে জোনায়েদ !
আমার ওপর কি
অনুগ্রহ করা হয়েছে
এবং তোমার আব্বার
প্রতি কি ন্যায়
বিচার করা হয়েছে” ?
জুনায়েদ বললেন, “আল্লাহ্
আপনাকে দুনিয়াদারী থেকে
মুক্ত করে আল্লাহ্র
কাজে লিপ্ত রেখে
পরকালের ধনে ধনী
করে আপনার প্রতি
অনুগ্রহ করেছেন। আর
আমার আব্বাকে দুনিয়ার
ধনে ধনী করে
দুনিয়ার কাজে লিপ্ত
রেখেছেন, এটা তাঁর
প্রতি ন্যায়বিচার। এখন
আপনার ইচ্ছা হয়
গ্রহন করুন অথবা
ফিরিয়ে দিন। তবে
উপযুক্ত পাত্রে যাকাত
পাঠিয়ে দেয়া আমার
আব্বার কর্তব্য”। হযরত
সররী সকতী (রহঃ) একথা
শুনে অতিশয় সন্তুষ্ট
হয়ে বললেন, “বাবা,
যাকাত গ্রহনের আগে
আমি তোমাকেই সাদরে
গ্রহন করছি”। এই বলে
দরজা খুলে তিনি
যাকাত গ্রহন করে
জুনায়েদকে আদরের সাথে
হৃদয়ে স্থান দিলেন।
জুনায়েদের বয়স
৭ বছর হলে
হযরত সররী সকতী
তাকে হ্জ্জ্ব করতে
মক্কা শরীফ নিয়ে
যান। সে সময়
কাবা শরীফে চারিশত
পীর মাশায়েখ জমায়েত
হয়েছিলেন। একদিন সেখানে
শোকর (কৃতজ্ঞতা) সম্পর্কে আলোচনা
হচ্ছিল। প্রত্যেকেই নিজ
নিজ মত প্রকাশ
করলেন। হযরত সররী
সকতী জুনায়েদকে বললেন,
“বাবা, তুমিও কিছু
বল”। জুনায়েদ কিছুক্ষণ
মাথা নীচু করে
করে পরে আজীজির
সাথে বললেন, “আল্লাহতা’য়ালা আমাদেরকে
যে নেয়ামত দান
করেছেন, সে নিয়ামত
পেয়ে যেন তাঁর
অবাধ্য নাফরমান না হই এবং
তাঁর নিয়ামতকে গোণাহের
কারণ বা উপকরণ
না করি- তাই শোকর”।
একথা শুনে পীর-মাশায়েখরা
বললেন, “হে আমাদের
নয়নের মনি ! তুমিই
উত্তম বলেছ, যথার্থ
সত্য বলেছ”। হযরত
সররী সকতী বললেন,
“বাবা, তুমি এরূপ
কথা কোথা থেকে
শিক্ষা করলে ?” জুনায়েদ
উত্তরে বললেন, “আপনার
সোহবতের (সান্নিধ্যের) বদৌলতে”।
তিনি বাগদাদে কাচেঁর
ব্যবসা করতে লাগলেন।
প্রতিদিন দোকানে গিয়ে
পর্দার আড়ালে থেকে
চারশত রাকাত নামায
পড়তেন। এভাবে কিছুদিন
চলার পড়ে তিনি
ব্যবসা ছেড়ে দিলেন
এবং হযরত সররী
সকতীর ঘরের সম্মুখস্থ
একটি চিলে কোঠায়
বসে আল্লাহ্র জিকর (স্মরণ) এবং আত্মসংযমে
মশগুল হলেন। ক্রমে
জিকরে এতই নিমগ্ন
হলেন যে, কখনও ধ্যানমগ্ন অবস্থায়
তিনি আসনের নিম্নভাগ
হতে মুছাল্লা সরিয়ে
ফেলতেন যাতে তার
অন্তরে আল্লাহ্ ছাড়া
অন্য কিছুর খেয়ালও
না আসতে পারে।
এইরূপে
তিনি চল্লিশ বছর
যিকিরে কাটিয়েছিলেন। ত্রিশ
বছর যাবত ইশার
নামাযের পর দাঁড়িয়ে
আল্লাহ্ আল্লাহ্ করতে
থাকতেন এবং সেই
ওযু দিয়েই ফজরের
নামায আদায় করতেন।
তিনি বলেন, “এভাবে
চল্লিশ বছর কেটে
যাওয়ার পরে আমি
লক্ষ্যস্থলে পৌঁছেছি বলে
ধারণা জন্মে”। আর
তখনই গায়েবী আওয়াজ
শুনলাম যে, “হে
জুনায়েদ, এখন তোমার
ভুতপরস্তির (মূতির্পূজার) সময় এসেছে”।
আমি গায়েবী আওয়াজ
শুনে বললাম, “জুনায়েদের
কি গোণাহ্ হল ?”
তখনই শোনা গেল,
“তুমি এখনও আছ,
এখনও তুমি নিজেকে
ডুবিয়ে দাও নি ?
এটা অপেক্ষা তুমি আর কি
গোনাহ চাও ?” জুনায়েদ
এক সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস
ফেলে লজ্জায় মাথা
নত করে বললেন,
“হায় ! যে এখনও
মাশুকের (প্রেমিকের) মিলনের অনুপযুক্ত,
বস্তুত প্রত্যেক নেক
কাজই তার গোনাহ
তুল্য বটে”।
তারপর
হতে পুণরায় তিনি
সেই ঘরে নির্জন
বাস করতে লাগলেন।
সারারাত তিনি সেখানে
আল্লাহ্ আল্লাহ্ করতেন।
বিরুদ্ধবাদীরা তাঁর এই
কাজের বিরোধী হয়ে
খলীফার দরবারে তাঁর
বিরুদ্ধে নালিশ করলে
খলীফা বললেন, “বিনা
প্রমাণে তাঁকে তাঁর
আপন কাজে বাধা
দেয়া যায় না”।
বিরুদ্ধবাদীরা বলল, “জনসাধারণ
তাঁর উল্টাপাল্টা কথায়
ও কাজে ধোঁকায়
পড়ে বিপথগামী হচ্ছে।
কাজেই তাঁকে শাসন
করা দরকার”। এই
কথা শুনে খলিফা
গোপনে জুনায়েদকে পরীক্ষা
করার সংকল্প করেন।
তিন হাজার দিরহাম
মূল্যে ক্রয় করা
খলিফার একটি অতীব
সুন্দরী দাসী ছিল। সে যুগে
এমন অপরূপা সুন্দরী
আর দ্বিতীয়টি ছিল
না। স্বয়ং খলিফা
নিজেই তার প্রতি
আসক্ত ছিলেন। এক
রাতে মহামূল্যবান অলংকার
ও মনিমুক্তা খচিত
পোষাক পড়িয়ে খলিফা
তাকে হুকুম করলেন,
“তোমাকে অমুক স্থানে
হযরত জুনায়েদের কাছে
যেতে হবে। সেখানে
গিয়ে অপরূপ ভঙ্গিমায়
জুনায়েদের সামনে নিজেকে
প্রকাশ করবে এবং
বলবে যে-- আমার
প্রচুর ধন-সম্পত্তি আছে,
কিন্তু বতর্মানে আমার
দুনিয়ার প্রতি বিতৃষ্ণা
জন্মেছে। তাই আমি এই বাসনা
নিয়ে আপনার কাছে
এসেছি যে, দয়া
করে আপনি আমাকে নিজ সান্নিধ্যে
স্থান দান করবেন।
আমি আপনার সাথে
থেকে বাকী জীবনটা
আল্লাহ্র ইবাদতে কাটিয়ে
দিতে চাই। এখন
আমার মন একমাত্র
এটাই চায় যে,
আপনাকে ছাড়া আর
কাহারও কাছে বসবও
না।” সুন্দরী বাঁদীকে
এটাও বলে দিলেন
যে, যতদূর পার
যত্ন-আত্তি ও তোষামোদ
করে জুনায়েদকে ভুলাতে
চেষ্টার কোন ত্রুটি
করো না। এই
কথা বলে খলিফা
বাঁদীকে বিদায় দিলেন
এবং ঘটনা কি
ঘটবে জানার জন্য
বুদ্ধিমান একটি গোলামকেও
সাথে পাঠালেন।
সুন্দরী
বাঁদী পরিকল্পনা মতো
জুনায়েদের কাছে পৌঁছেই
মুখের ঘোমটা খুলে
ফেলল। ঘটনাক্রমে জুনায়েদের
নজর হঠাৎ একবার
তার ওপর পড়তেই
তিনি মাথা নীচু
করে ফেললেন। বাঁদীকে যে-সব
কথা কথা বলতে
নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল,
তার সবই সে
জুনায়েদকে লক্ষ্য করে
বলতে লাগল। ভদ্রতা,
বিনয়, খোষামোদ, পীড়াপীড়ি
ইত্যাদি কোনটাই সে
করতে ছাড়েনি। জুনায়েদ
নত মুখেই বাঁদীর
সকল কথা শুনে
অবশেষে মাথা উঠিয়ে
“আহ্ আহ্” (হায় ! হায় !)
বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস
ছাড়লেন। আর সাথে
সাথেই বাঁদী বেহুঁশ
হয়ে মাটিয়ে লুটিয়ে
পড়ে প্রাণত্যাগ করে।
চাকরটি দৌঁড়ে গিয়ে
খলীফাকে এই সংবাদ
জানাল। খলীফা দুঃখিত
হলো বলল, “যে
ব্যক্তি আল্লাহ্র আশেকের
সাথে এমন আচরণ
করবে যা করার
মতো নয়, তবে
তার ফলাফলও এমন
দেখবে যা দেখার
মতো নয়”। সাথে
সাথেই উঠে খলীফা স্বয়ং
জুনায়েদের খিদমতে হাজির
হলেন। লোকে খলীফাকে
স্বয়ং সেখানে যেতে
নিষেধ করে বরং
জুনায়েদকে তাঁর দরবারে
উপস্থিত হওয়ার জন্য
অনুরোধ করতে পরামর্শ
দিল। কিন্তু খলীফা
বললেন, “এমন মান্যবর
বুজুর্গ ব্যক্তিকে দরবারে
তলব করা উচিত
নয়, বরং নিজেই
তাঁর দরবারে যাওয়া
কর্তব্য”।
খলীফা
গিয়ে বিনয়ের সাথে
হযরত জুনায়েদকে বললেন,
“হুজুর, এমন সুন্দরের
উপমাকে ছাড়খার করতে
আপনার মন সায়
দিলো” ? জুনায়েদ বললেন,
“আমীরুল মোমেনীন, মোমিনদের
প্রতি কি আপনার
এমনই মেহেরবানী যে,
আপনি ইচ্ছা করলেন,
আমার চল্লিশ বছরের
ঘুম হারাম করা
সকল বন্দেগী-সাধনার ফল
একজন বাঁদী বরবাদ
করুক ! আর আমি
এই (মৃত্যুর) ব্যাপারে
কে ? আমার
ক্ষমতাই বা কি
? নগণ্য ব্যক্তি
আমি, যদি কাহাকেও
এসব করতে নিষেধ
করতাম, তবে কে
আমার কথা শুনত !
যা হোক, আপনি
ভবিষ্যতে এমন কাজ করবেন
না।” এরপর জুনায়েদ
আরও উন্নতি করলেন।
সারা দুনিয়ায় তাঁর
সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল।
যেই বিষয়ে জুনায়েদকে
পরীক্ষা করা হলো,
তিনি এটা অপেক্ষা
হাজার গুণ অধিক
বুজুর্গ বলে প্রমাণিত
হলেন। ইহার পর
মহাত্মা জুনায়েদ জনসম্মুখে
ওয়াজ করতে আরম্ভ
করলেন। একদিন তিনি
বললেন যে, “পর
পর চল্লিশজন আব্দাল
আমাকে ওয়াজ করতে
অনুরোধ ও বাধ্য
করার পর আমি
ওয়াজ করতে আরম্ভ
করেছি। আমি দুইশত
পীরের খিদমত করেছি,
যাদের সকলেই অনুসরণের
যোগ্য”। তিনি আরো
বলেন, “যে ব্যক্তি
আল্লাহ্র বাণী কোরআন
শরীফকে ডান হাতে
এবং রাসুলুল্লাহর বাণী
সুন্নাহ্কে বাম হাতে
নিয়ে উভয় বাতির
আলোকে পথ চলে,
কোন সন্দেহের গর্তে
না পড়ে বা
বিদআতের অনুসারী না
হয়, এমন ব্যক্তিরই
দরবেশীর পথে পা
বাড়ানো কর্তব্য”।
তিনি
বলেন যে, “হযরত
আলী কার্রামাল্লাহু মারিফাতের
মৌলিক তত্ত্ব ও
শাখাসমূহের এবং কষ্টসহিষ্ণুতার দরজা
খুলে দিয়েছেন। আল্লাহ্
পাক তাঁকে বিবিধ
জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন।
তিনি যদি একটি
কথা না বলতেন
তাহলে তরীকতপন্থীগণ এখন
না জানি কি
করতেন ! সেই সার
কথাটি হলো ঃ “লোকে
জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি
কিভাবে আল্লাহ্ পাককে
চিনতে পেরেছেন ?” উত্তরে
হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন,
“আল্লাহ্ পাক নিজে
আমাকে আত্মপরিচয়ে অবহিত
করেছেন যে, তিনি
এমন সত্ত্বা, যাঁর
দ্বিতীয় তুলনাও হতে
পারে না। কোন আকৃতি দিয়ে
তাঁকে কল্পনা করা
চলে না, কোন
সৃষ্টির উপর তাঁকে
অনুমান করা যায়
না”। তিনি বহু
দূরে হলেও নিকটে,
নিকটে হওয়া সত্ত্বেও
বহু দূরে। তিনি
সকলের উপরে আছেন,
অথচ এটাও বলা
যায় না যে,
তাঁর নীচে কোন
বস্তু আছে। তিনি
কোন বস্তুর মতো
নন। আবার তিনি
কোন বস্তু হতে
সৃষ্টও নন, কোন
বস্তুর উপরেও তিনি
নন। উপরে বর্ণিত
ঐসব গুণে তিনি
ব্যতীত আর কেউ
গুণান্বিত নয়। কেউ
একথার বিস্তারিত ব্যাখ্যা
দিতে চাইলে এক
বিরাট গ্রন্থের প্রয়োজন”।
জুনায়েদের
সাথে দশ হাজার
খাঁটি মুরীদকে মা’রেফাতের
পথে তৌহিদের দরিয়ায়
ডেকে দেওয়া হলো।
শেষ পযর্ন্ত আবুল
কাশেম জুনায়েদ ব্যতীত
আর কেউ ভেসে
ওঠল না। তারপর
তাঁকে ঈমানরূপ আসমানের
সূরযে পরিণত করা
হল। ব্যাস্, এতটুকুতেই
যে বুঝল, বুঝে
নিল ; এর বেশী
ব্যাখ্যা চলে না,
তাতে পথভ্রষ্ঠ হওয়ার
আশঙ্কা আছে। তিনি
বলেন, যদি আমি
হাজার বছর বেঁচে
থাকি, তবে যতক্ষণ
পযর্ন্ত আল্লাহপাক আমাকে
আমল হতে ফিরিয়ে
না রাখেন, ততক্ষণ
পযর্ন্ত আমি নেক্
কাজ একটুও কম
করব না। তিনি
আরও বলেন, যদি
নামাযের মধ্যে আমার
দুনিয়ার কোন খেয়াল
আসত, তখনই আমি
সে নামায দ্বিতীয়বার
পড়ে নিতাম। আর
নামাযের মধ্যে যদি
আমার জান্নাত-জাহান্নাম বা
আখেরাতের স্মরণ হতো,
তখন সাহু সিজদা
করতাম।
একদা
জুনায়েদ তাঁর মুরীদদেরকে
বললেন, “যদি জানতাম
যে তোমাদের সাথে
বসা অপেক্ষা দুরাকাত
নফল নামায পড়া
উত্তম, তবে আমি
কখনও তোমাদের সাথে
বসতাম না”। তিনি
সবসময় রোজা রাখতেন।
তবে যখন তাঁর
কোন বন্ধু আসতেন,
তখন তিনি নফল
রোজা ভঙ্গ করে
তাদের সাথে খেতে
বসে যেতেন এবং
বলতেন, “মুসলিম ভাইদের
কাজে সহযোগিতা করা
নফল রোজা হতে
উত্তম”। জুনায়েদ সবসময়
আলেমদের মতো পোষাক
পরিধান করতেন। একবার
লোকেরা তাঁকে বলল,
“আপনি আপনার বন্ধুদের
মতো গুদরী (দরবেশী কোর্তা)
পরছেন না কেন ?”
তিনি বললেন, “যদি
জানতাম, গুদরী ব্যবহার
করলেই মকসুদ হাসিল
হবে, তবে আমি
লোহা এবং আগুনের
গুদরীও পড়তে দ্বিধা
করতাম না ; কিন্তু
প্রতি মুহূর্তে প্রাণের
ভেতর থেকে এই
ডাক আসছে যে,
খেরকায় বিশ্বাস নেই
বরং আল্লাহ্ প্রেমে
জ্বলে যাওয়াতেই বিশ্বাস।”
জুনায়েদ
কামালিয়াত অর্জন করলে
তাঁর মোরশেদ হযরত
সিররী সিকতী তাঁকে
জনসম্মুখে ওয়াজ করতে
বললেন। তিনি ভয়ে
ওয়াজ করতে সাহস
করলেন না এবং
বললেন, “স্বীয় পীর
সাহেব বর্তমান থাকতে
মুরীদের ওয়াজ করা
সম্পূর্ণ নীতিবিরুদ্ধ এবং
বেয়াদবী”। তারপর এক
রাতে স্বপ্নে দেখলেন
যে, হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) স্বয়ং
তাঁকে বলছেন যে,
জুনায়েদ তুমি মানুষকে
ওয়াজ-নসীহত কর। তিনি
ভোর বেলায় উঠে
এই খোশ্ খবর
আপন পীর সররী
সিকতীর কাছে প্রকাশ
করতে যেতে উদ্যত
হলেন। তখনই দেখলেন
সররী সকতী স্বয়ং
তাঁর দরজায় উপস্থিত।
তিনি বললেন, “কিহে
জুনায়েদ ! এখনও কি
তুমি সেই পূর্বের
খেয়ালে আছ ? আমরা
ত বহু পূর্ব
হইতেই তোমাকে ওয়াজ
করতে অনুরোধ করে
ব্যর্থ হয়েছি। তুমি
আমাদের কারো অনুরোধ
রক্ষা করো নাই।
এখন স্বয়ং হযরত
মোহাম্মদ (সাঃ) আদেশ করেছেন,
এখন কি করবে ?”
জুনায়েদ
বললেন, “মামা, আপনি
কিভাবে জানতে পারলেন
যে, আমি হযরত
মোহাম্মদ (সাঃ) স্বপ্নে দেখেছি ?”
হযরত সিররী সিকতী
বললেন, “আজ রাতে
আমি স্বপ্নযোগে আল্লাহ্
পাককে এই কথা
বলতে শুনলাম যে,
আমি হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) কে
জুনায়েদের নিকট মিম্বরে
উঠে ওয়াজ করতে
হুকুম দেওয়ার জন্য
পাঠিয়েছি।” তাঁর কথা
শুনে জুনায়েদ বললেন,
“নিশ্চয়ই আমি ওয়াজ
করব, তবে এ
শর্তে যে, আমার
মজলিশে চল্লিশ জনের
বেশী শ্রোতা উপস্থিত
থাকতে পারবে না”।
ইহার পর একদিন
তিনি ওয়াজ করেন।
সেই মজলিশে কথামতো
চল্লিশজন শ্রোতাই উপস্থিত
ছিলেন। ওয়াজ শুনে
আঠারোজন লোক সেই
মাহফিলেই ইন্তেকাল করলেন।
অবশিষ্ট বাইশ জন
এমন বেহুঁশ হলেন
যে, লোকজন এসে
কাঁধে করে তাদেরকে
বাড়ী নিয়ে যায়।
জুনায়েদ (রঃ)
বলেন, “একবার আমার
মন হারিয়ে গিয়েছিল।
আমি আল্লাহ্তায়ালার কাছে
আবেদন করলাম, “হে
আল্লাহ, আমাকে আবার
আমার মন ফিরিয়ে
দাও।” তখন এ
আওয়ায শুনতে পেলাম,
“হে জুনায়েদ, আমি
এজন্য তোমার মন
নিয়ে রেখে দিয়েছি
যেন তুমি আমার
সাথে থাক। তুমি
কি অন্যের মুখের
দিকে তাকিয়ে থাকার
জন্য আমার মন
ফিরে চাচ্ছ ?” বর্ণিত
আছে যে, একবার
শিবলী (রহঃ) বললেন, “যদি
কিয়ামতের দিন আল্লাহ্
তায়ালা আমাকে জান্নাত
এবং জাহান্নাম যা
ইচ্ছা গ্রহন করার
জ্ন্য হুকুম করেন,
তাহলে আমি জাহান্নাম
গ্রহন করব। কেননা,
জান্নাত গ্রহন করা
আমার কাম্য, অপরদিকে
এস্থলে জাহান্নাম গ্রহন
করি কিনা এটা
দেখাই আমার বন্ধুর (আল্লাহর) উদ্দেশ্য।
সুতরাং যে বন্ধুর
ইচ্ছার উপর আপন
ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়,
তাকে প্রকৃত বন্ধু
বলা উচিত নয়”।
জুনায়েদ এই উক্তি
শুনে বললেন, “শিবলীর
এখনও বালকের চপলতা
দূর হয় নি।
যদি আল্লাহ্পাক আমাকে
এরূপ ইখতিয়ার প্রদান
করেন, তাহলে আমি
(জান্নাত-জাহান্নাম) কোনটিই গ্রহন
করব না। কেননা,
বান্দার আবার ইচ্ছা
কি ? বরং আমি
বলব, “হে আল্লাহ,
তুমি আমাকে যেখানে
পাঠাও, আমি সেখানেই
যাব। তোমার যা
পছন্দ, আমি তাতেই
সন্তুষ্ট”।
একদিন
জুনায়েদ একজন দরবেশ
রোগীকে দেখতে গেলেন।
গিয়ে দেখলেন যে,
দরবেশ রোগের যন্ত্রণায়
কাঁদছে। জুনায়েদ বললেন,
“এই ক্রন্দন দিয়ে
কার বিরুদ্ধে অভিযোগ
করছ”? দরবেশ চুপ
করে রইলেন। জুনায়েদ
বললেন, “আমার (নিজের)
কাঁদারও কোন উপকরণ
নাই, আবার সবর
করবারও কোন শক্তি
নাই।” একদিন জুনায়েদের
শরীরের কিছু ব্যথা
হয়েছিল। তিনি সুরায়ে
ফাতেহা পাঠ করে
সেখানে ফুঁক দিলেন।
তখনই গায়েব থেকে
কে যেন ডেকে
বলল, “তোমার লজ্জা
হয় না যে,
আমার কালামকে তুমি
নিজের স্বার্থে ব্যবহার
করছ”? জুনায়েদ বলেছেন
যে, একদিন আমার
ইবলীসকে দেখার বড়
আকাঙ্খা হলো। কিছুক্ষণ
পর আমি মসজিদের
দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে
দূর হতে একজন
বৃদ্ধকে আমার দিকে
আসতে দেখলাম। তাকে
দেখেই আমার মনে
একটু ঘৃণার ভাব
হল। আমি জিজ্ঞেস
করলাম, “তুমি কে ?”
সে উত্তরে বলল,
“আমি তোমার আকাঙ্খা।”
আমি বললাম, “হে
মালাউন, কে তোকে
হযরত আদমকে (আঃ) সিজ্দা
করতে নিষেধ করেছিল ?”
সে বলল, “হে
জুনায়েদ ! এটা আবার
আমার পক্ষে কবে বৈধ ছিল
যে, আমি আল্লাহ্
তাআলা ব্যতীত অন্যকে
সিজদা করব ?” জুনায়েদ
বলেন, “আমি তার
উত্তর শুনে হতবাক
হয়ে রইলাম”। তখনই
গায়েব হতে আওয়াজ
এল, “হে জুনায়েদ !
তুমি শয়তানকে বল,
“তুই মিথ্যা কথা
বলছিস। যদি তুই
আল্লাহর দাস হইতি,
তাহলে কখনও আল্লাহ্
পাকের হুকুম অমান্য
করতি না এবং
তাঁর নিষিদ্ধ বস্তুর
কাছেও যেতে না।”
একথা শুনা মাত্র
ইবলীস চীৎকার করে
বলল, “আল্লাহর কসম,
তুমি আমাকে জ্বালিয়ে
ছিয়েছ।” একথা বলেই
সে অদৃশ্য হয়ে
গেল।
একদিন
জুনায়েদের কাছে এক ব্যক্তি এসে
বার বার বলতে
লাগল, “বর্তমানে ধার্মিক
ও দ্বীনদার লোক
খুবই কম এবং
খোঁজ করেও পাওয়া
যাচ্ছে না”। কিছুক্ষণ
পর জুনায়েদ বললেন,
“যদি এরূপ লোক
চাও যে, সে
তোমার বোঝা উঠাতে
সক্ষম, তবে তা
সহজে মিলবে না !
অপরদিকে যদি এমন
লোক চাও যে,
তুমি তার বোঝা
বহন করবে, তবে
আমার কাছে এমন
লোক বহু আছেন”।
একদিন ইবনে শুরায়হ্
জুনায়েদের কাছে উপস্থিত
হলেন। লোকেরা চিনতে
পেরে শুরায়হ্কে আগ্রহের
সাথে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি জুনায়েদের উক্তিসমূহকে
কেমন মনে করেন ?”
তিনি বললেন, “তাঁর
উক্তিসমূহ আমার অতি
আশ্চরযজন বলে মনে
হচ্ছে।” লোকে বলে,
“আচ্ছা বলুন ত,
জুনায়েদ যা বলেন
তা কি তিনি নিজ ইল্ম
বা জ্ঞান দ্বারা
বলছেন ?” ইবনে শুরায়হ্
বলেন, “তা ত
আমি জানি না,
তবে এতটুকু বলা
যেতে পারে যে, তাঁর
কথা বড় তাৎপরযপূর্ণ
এবং এই কথাগুলো
যেন আল্লাহ্তাআলা তাঁর
মুখ দিয়ে বলাচ্ছেন।”
উল্লেখ আছে যে,
একদিন শিবলী (রহঃ) মসজিদে
হঠাৎ বলে উঠলেন,
“আল্লাহ্র মহত্ত অসীম”।
একথা শুনে জুনায়েদ
বললেন, “হে শিব্লী,
যদি আল্লাহ্ পাক
গায়ের (অনুপস্থিত) হন, তাহলে
অনুপস্থিত ব্যক্তির আলোচনা
করা গীবত এবং
গীবত করা হারাম।
পক্ষান্তরে যদি আল্লাহ্
তাআলা উপস্থিত থাকেন,
তবে উপস্থিত ব্যক্তির
নাম নেওয়া আদবের
খেলাফ বা নীতি-বিরুদ্ধ
কাজ”। একদিন এক
ব্যক্তি জুনায়েদের আছে
জিজ্ঞেস করল, “অন্তর
কখন সন্তুষ্টি লাভ
করে ?” উত্তরে বললেন,
“যখন এতে তিনি (আল্লাহ্ পাক)
বিদ্যমান থাকেন।”
জুনায়েদ
বলেন, “আমি এক
ক্ষৌরকারের কাছে ইখ্লাস
বা খাঁটি আল্লাহ্
প্রেম শিক্ষা লাভ
করেছি। আমি যখন
মক্কা শরীফে ছিলাম,
একজন ক্ষৌরকার এক
ব্যক্তির মাথা কামাচ্ছিল।
আমি ওকে বললাম,
“ওহে, আল্লাহ্র ওয়াস্তে
আমার চুলগুলো কেটে
দিবে কি ?” সে
বলল, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই
দিব” এবং সাথে
সাথে তার চোখ
পানিতে ভরে ওঠল।
এখনও পযর্ন্ত সেই
লোকটির চুল কামানো
শেষ হয়নি, তথাপি
সেই লোকটিকে বলল,
“আপনি একটু উঠে
যান। এখন আপনাকে
কামাতে পারলাম না।
কেননা, ইনি যখন
আল্লাহ্ পাকের পবিত্র
নাম মধ্যখানে যিক্র
করেছেন, তখন তাঁকে
আগে কামাতে হবে।”
এটা বলে সে
আমাকে সাদরে কাছে
বসাল এবং আমার
মাথা চুম্বন করে
ক্ষৌরকর্ম শুরু করল।
তারপর একটি কাগজের
পুরিয়া আমার হাতে
দিয়ে বলল, “এগুলো
আপনার নিজ কাজে
ব্যয় করুন”। এতে
কিছু স্বর্ণ মুদ্রা
ছিল। আমি তার
এ উদারতা দেখে
মনে মনে সংকল্প
করলাম যে, যখনই
আমার হাতে ধন
আসবে, তখনই সর্বপ্রথম
ক্ষৌরকারের এ বদান্যতার
প্রতিদান দিব।
এই ঘটনার কয়েকদিন
পরই বসরার জনসাধারণ
আমাকে এক থলি
আশ্রফী (সোনার মোহর) পাঠিয়ে
দিল। আমি এগুলো
নিয়ে ক্ষৌরকারের কাছে
উপস্থিত হলাম। সে
মুদ্রা দেখে জিজ্ঞেস
করল, “এটা কি ?”
আমি বললাম, “ক্ষৌরকর্মের
দিন সংকল্প করেছিলাম,
আমি এরপর প্রথম
যে অর্থ পাব
তা তোমাকে দিব।”
সে আমাকে বলল,
“আল্লাহ্র নামে কি
আপনার লজ্জা হয়
না যে, আল্লাহ্র
ওয়াস্তে আমার চুলগুলো
কেটে দিবে কি ? বলে এখন
আবার তার প্রতিদান
কেন ? আপনি কি কাউকেও এরূপ
দেখেছেন যে আল্লাহ্র
খুশির জন্য কাজ
করে আবার এর
পরিবর্তে পারিশ্রমিক গ্রহন
করে ?” আমি তার
উত্তর শুনে অবাক
হয়ে গেলাম !
একবার
আলী ইবনে সহল
হযরত জুনায়েদকে এই
বলে পত্র লিখলেন ঃ
“আমার অলসতার নিদ্রা
এবং চিন্তাহীন ভাব
অধিক, অপরদিকে প্রকৃত
প্রেমিকের নিশিন্ত ভাব
ও নিদ্রা বাঞ্ছনীয়
নয় ; কেননা নিদ্রিত
ব্যক্তির বাসনা পূর্ণ
হয় না এবং
সে আপনার আত্মশুদ্ধি
ও অমূল্য সময়
সমন্ধে অলস থেকে
যায়। যেমন ঃ আল্লাহ্
তায়ালা হযরত দাউদ (আঃ)
কে ওহী পাঠিয়েছিলেন
যে, যে ব্যক্তি
আমার প্রেমের দাবী
করে অথচ রাত্রি
এলে প্রেম ছেড়ে
আরামে নিদ্রা যায়,
সে মিথ্যাবাদী।” ইহার
উত্তরে জুনায়েদ লিখেছেন
যে, “আল্লাহ্র পথে
আমাদের জেগে থাকাটা
আমাদের ইচ্ছাধীন কাজ।
আর নিদ্রা আল্লাহ্
পাকের কাজ এবং
আমাদের প্রতি এটা
তাঁর একটি মহা
দান বটে। সুতরাং
যে জিনিস আমাদের
আয়ত্তের বাইরে এবং
আল্লাহ্ পাক হতে
প্রাপ্ত, তাকে আমাদের
ইখতিয়ারাধীন বস্তু হতে
বহুগুণে শ্রেষ্ঠ বলে
জানবে। এটা আল্লাহ্ তাআলার বন্ধুগণের
উপর তাঁর করুণা।”
একদিন
বাগদাদে এক চোরকে
ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো দেখে
জুনায়েদ সে লাশের
পা চুম্বন করেন।
লোকে বলল, “একি
করেন। সে যে
চোর ছিল !” জুনায়েদ
বলেন, “আল্লাহ্ পাক
তার উপর হাজার
রহমত নাযেল করুন।
কেননা সে এক
কৃতিত্বের অধিকারী। সে
আপন কাজে রত
থেকে মারা গেছে
এবং যে কাজ
আরম্ভ করেছিল তাকে
শেষ সীমায় পৌঁছিয়ে
ছেড়েছে।” একদিন এক
ব্যক্তি এসে বলল,
“আমি ক্ষুধার্ত ও
বস্ত্রহীন অবস্থায় আছি।”
জুনায়েদ বললেন, “যাও,
নিশ্চিন্ত থাক। যে
আল্লাহ্র নিন্দা করে
আকাশ-বাতাস বিষাক্ত করে
তোলে, তিনি তাকে
কষ্ট দেন না ;
বরং আল্লাহ্ তাআলা যাকে
ভালবাসেন, তাকেই অন্ন-বস্ত্রে
ক্লেশ দিয়ে থাকেন।
তুমি তাঁর নিন্দা
করো না।”
এক ধনী ব্যক্তির
রীতি ছিল যে,
সে কখনও সুফীদেরকে
ছাড়া আর কাউকে
দান করত না
এবং বলত যে, “যেহেতু সুফীদের
আল্লাহ্ পাকের যিকর
ব্যতীত অন্য লক্ষ্য
নাই, অভাবে পড়লে
তাদের মন ও
সাহস ছিন্ন হয়ে
আল্লাহ্ তায়ালা হতে
দূরে সরে যেতে
পারে, সুতরাং দুনিয়াদার
হাজার লোককে দান
করার চাইতে তাঁদের
একজনকে দান করে
আল্লাহ্র রাস্তায় নিয়ে
যাওয়া শ্রেয়।” জুনায়েদ
একথা শুনে বললেন,
এটা ত কোন
আল্লাহ্ প্রেমিকের কথা
বটে। অতঃপর সে
দাতা অকাতরে দান
করতে করতে নিঃস্ব
হয়ে গেল। তখন
জুনায়েদ তাকে কিছু
অর্থ দান করে
বলেন, “একে মূলধন
করে তুমি বাণিজ্য
কর। তোমার মতো
লোকের পক্ষে বাণিজ্য
করা অনুচিত নয়।”
জুনায়েদের
একজন মুরীদ তার
প্রভূত ধনসম্পত্তি পীর-সাহেবের
পায়ে উৎসর্গ করেছিলেন।
কেবল তার কাছে
একখানা ঘর অবশিষ্ঠ
ছিল। একদিন মুরীদ
জুনায়েদ (পীর)কে জিজ্ঞেস
করলেন, “এখন আমি
কি করব ?” তিনি
বললেন, “ঘরটি বিক্রি
করে ফেল এবং
ইহার মূল্য আমার
নিকট নিয়ে এসো।”
তিনি গিয়ে ঘরখানা
বিক্রি করে টাকা
নিয়ে এলেন। জুনায়েদ
হুকুম করলেন, “টাকাগুলো
নদীতে ফেলে দাও”।
তিনি এরূপই করলেন।
অবশেষে সহায়-সম্ভলহীন হয়ে
তিনি পীর সাহেবের
পিছু পিছু চললেন।
তখন জুনায়েদ তাকে
তাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“আমার কাছ থেকে
যাও- তুমি কেন
আমার পিছনে পিছনে
আসছ ?” তিনি যতই
অনুনয় বিনয় করতে
লাগলেন, পীর সাহেব
ততই তাকে তাড়িয়ে
দিতে লাগলেন। কিন্তু
তিনি কিছুতেই পিছু
ছাড়লেন না। অবশেষে
এভাবে পীর সাহেবের
পিছু আঁকড়িয়ে ধরে
থাকার ফলে সে
ব্যক্তির উদ্দেশ্য সিদ্ধ
হলো, তিনি জীবনে
কামালিয়াত লাভে সক্ষম
হলেন।
কথিত
আছে, একবার এক
মুরীদের মাথায় পাগলামি
খেয়াল চাপল যে,
“আমি কামেল দরবেশ
হয়ে গেছি। কাজেই
আমার পক্ষে পীরের
সঙ্গ ব্যতীত একাকী
থাকাই উত্তম।” এই
বলে সে নির্জনে
বাস করতে লাগল।
তখন তার এরূপ
অবস্থা হলো যে,
সে প্রত্যেক রাত্রিতে
স্বপ্নে দেখত যে,
ফেরেশতাগণ উট নিয়ে
হাজির হয়ে তাকে
বলছে, তোমাকে জান্নাতে
নিয়ে যাব। সে সেই উটে
চড়ত। উট তাকে
নিয়ে যেতে যেতে
এমন মনোরম স্থানে
পৌঁছত যে, সেখানে
দেখা যেতো বহু খুবসুরত ও
সুদৃশ্য লোকদের সমাবেশ।
উত্তম ও উপাদেয়
খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুত। সম্মুখে
সুপেয় পানির নদী
বইছে। সে স্বপ্নের
মধ্যেই সেখানে নেমে
পড়ত এবং বহুক্ষণ
সেখানে অবস্থান করে
ঘুম থেকে জেগে
উঠে দেখত যে,
সে নিজের ঘরেই
অবস্থান করছে। তার
এই খামখেয়ালী ক্রমে
ক্রমে এমন পরযায়ে
পৌছল যে, সে
নিজেই জনসাধারণের কাছে
প্রচার করতে লাগল
যে, “আমি প্রতি
রাতেই একবার জান্নাতে
গিয়ে থাকি।” ঘটনাক্রমে
এ সংবাদ জুনায়েদের
কানে পৌঁছলে একদিন
তিনি সেই দরবেশের
কুটিরে গিয়ে দেখলেন
যে, দরবেশ তার
সহচরদের নিয়ে খুব
শান-শওকতের সাথে বসে
আছে। জুনায়েদ তার
সমাচার জানতে চাইলে
সে আগাগোড়া সব
বর্ণনা করল। জুনায়েদ
বললেন, “আচ্ছা বৎস,
আজ রাতে তুমি
তোমার কথিত জান্নাতে
পৌঁছলে “লা হাওয়া
ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা
বিল্লাহ্” দোয়াটি অবশ্যই
তিনবার পড়বে।” দরবেশ
আগের মতোই ঘুমে
অচেতন হলে আজ
রাতেও সে কথিত
বেহেশতে পৌঁছল। তখন
পীর সাহেবের কথা
তার স্মরণ হলে
সে পরীক্ষাস্বরূপ “লা
হাওলা...” দোয়াটি পড়ল।
এটা শোনামাত্র উপস্থিত
সকলেই প্রমোদ আসর
ভেঙ্গে চীৎকার করতে
করতে তাকে একাকী
ফেলে যে যেদিকে
পথ পেল পালাল।
অতঃপর সে দেখতে
পায় যে, একটি
কুশ্রী ঘোড়ায় চড়ে
সে এক নোংরা
স্থানে উপস্থিত হয়েছে
এবং সেখানে সম্মুখে
মৃত জন্তুদের দুর্গন্ধপূর্ণ হাড্ডি
পড়ে আছে। তখন সে নিজের
ভুল বুঝতে পারল।
ভোরে ঘুম থেকে
জেগেই সে পীর
সাহেবের খেদমতে হাজির
হয়ে তওবা করল
এবং বুঝতে পারল
যে, মুরীদের পক্ষে
পীরকে ছেড়ে একাকী
বসবাস করা বিষতুল্য।
একবার
জুনায়েদ (রহঃ) এক
মজলিশে ওয়াজ করছিলেন।
এক মুরীদ ভাবের
আতিশয্যে চীৎকার করে
উঠল। জুনায়েদ তাকে
নিষেধ করলেন এবং
কঠোরভাবে সতর্ক করলেন,
“যদি তুমি আর
কখনও এরূপ চীৎকার
কর, তবে তোমাকে
আমার মজলিশ থেকে
বের করে দিব”।
তৎপর তিনি পূর্বের
ওয়াজ খানি প্রথম
থেকে পুণরায় শুরু
করলেন। সে যুবক
প্রাণপন চেষ্ঠা করল,
কিন্তু নিজেকে সামলাতে
পারল না। ভিতরের
গুমড়ানো আবেগে শ্বাসরুদ্ধ
হয়ে সে প্রাণত্যাগ
করল। এক মুরীদ
জুনায়েদের সাথে কোনও
একটি বিষয়ে বেআদবী
করে লজ্জায় বের
হয়ে যায় এবং
এক মসজিদে গিয়ে
অবস্থান করতে থাকে।
একবার জুনায়েদ (রহঃ) সেই
পথে কোথাও যাচ্ছিলেন,
হঠাৎ মুরীদের প্রতি
তাঁর নজর পড়ে।
কিন্তু হায় ! জুনায়েদের
চোখে চোখ পড়া
মাত্র সে ভয়ে
মাটিতে পড়ে গেল
এবং মাথা ফেটে
কপাল বেয়ে রক্ত
পড়া শুরু করল।
রক্তের যে ফোটা
মাটিতে পড়ছিল, তাতে
অবিকল আরবীতে “আল্লাহ্
জাল্লা জালালুহু” অক্ষরের
আকৃতি ধারণ করছিল।
জুনায়েদ (রহঃ) তা দেখে
বললেন, “কি হে,
তুমি কি আমাকে
দেখাতে চাচ্ছ যে,
তুমি মা’রিফাতের একেবারে
উচ্চশ্রেণীতে পৌঁছে গেছ ?
মনে রেখো, ছোট
ছোট বালকেরাও (আল্লাহ্র)
যিকরে তোমার সমান
বটে ; কিন্তু পুরুষকে
ত যিক্রের নির্ধারিত
সীমা পযর্ন্ত পৌঁছা
কর্তব্য”।
পীরসাহেবের
কথায় তার অন্তরে
এমন ভীষণ আঘাত
লাগল যে, তখনই
সে ধড়ফড় করে
প্রাণত্যাগ করল। তারপর
তাকে যথারীতি দাফন
করা হলো। কিছুদিন
পর এক বুযুর্গ
ব্যক্তি তাকে স্বপ্নে
দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি নিজেকে কোন্
স্তরে পেলে ?” সে
উত্তরে বলল, “বহু
বছর যাবত দৌড়াদৌড়ি
করেছি, কিন্তু দেখি,
এখনও কুফরীর সীমায়
রয়ে গেছি। ধর্ম
এখনও বহু দূর !
এখন বুঝেছি যে,
আমার পূর্বের সমস্ত
ধারণাই ভুল ছিল”।
উল্লেখ আছে যে,
বসরা নগরীতে জুনায়েদের
একজন মুরীদ ছিলেন।
তিনি নির্জনবাস করছিলেন।
একদিন তাঁর অন্তরে
কোনও একটি পাপ
কাজের হয়ত ধারণা
জন্মেছিল। তখন আয়নায়
নিজের মুখ দেখতে
গিয়ে দেখেন, মুখটি
কালো বর্ণ ধারণ
করেছে। এতে তিনি
অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে
পড়লেন। বহু তদবিরও
করলেন কিন্তু কোন
ফল হল না।
এজন্য লজ্জায় কাউকেও
তিনি মুখ দেখাচ্ছিলেন
না। তিনি দিন
পর দেখা গেলো,
তাঁর অন্ধকার চেহারা
ফর্সা হয়ে ক্রমে
ক্রমে আসল রূপ
ফুটে উঠেছে। ইতিমধ্যে
একব্যক্তি এসে দরজায়
টোকা দিল। তিনি
ভিতর থেকে বলে
উঠলেন, “কে ?”
উত্তর হলো, “আমি
জুনায়েদের পত্র নিয়ে
এসেছি”। দরজা খুলে
তিনি পত্র হাতে
নিয়ে পড়তে লাগলেন।
পত্রে লেখা ঃ “বন্দেগীর
পবিত্র দরবারে থাকতে
কেন আদব রক্ষা
করে চল না ?
যদ্দরুন আমাকে তিন
দিন যাবত ধোপার
কাজ করতে হচ্ছে
যেন তোমার কাল
মুখ সাদায় পরিণত
করতে পারি।”
একদিন
জুনায়েদ এক মুরীদসহ
ময়দানের দিকে হাঁটতে
যান, সেই মুরীদের
জামার এক অংশ
ছেড়াঁ ছিল। সে
দিন রোদ ও
ছিল খুব প্রখর
এবং ছেঁড়া স্থান
দিয়ে রোদ তার
গায়ে লাগছিল। সে
গরমে অস্থির হয়ে
গেল, এমনকি তার
নাক দিয়ে রক্তের
ফোঁটা পড়তে লাগল।
তখন সে বলল,
“আজ বড় গরম
পড়ছে”। জুনায়েদ একথা
শুনেই ক্রোধভরে তার দিকে
তাকিয়ে বলেন, “চলে
যাও, তুমি আমাদের
সঙ্গী হওয়ার উপযুক্ত
নও”। তারপর তাকে
আপন দল থেকে
বের করে দিলেন।
বর্ণিত আছে, সৈয়দ
নাসেরী নামক এক
ব্যক্তি হ্জ্জ করতে
যাওয়ার পথে বাগদাদ
নগরীতে পৌছঁলেন এবং
হযরত জুনায়েদের সাথে
সাক্ষাত করতে এলেন।
জুনায়েদ জিজ্ঞেস করলেন,
“কোথা থেকে তশ্রীফ
আনলেন ?” তিনি বললেন,
“জীলান হতে।” জুনায়েদ
বললেন, “আপনি কোন্
বংশের লোক ?” সেই
ব্যক্তি উত্তরে বললেন,
“আমিরুল মো’মেনীন হযরত
আলী (রাঃ)এর বংশধর।” জুনায়েদ
বললেন, “আপনার দাদা [অর্থাৎ আলী (রাঃ)]
ত দুই তরবারি
পরিচালনা করতেন, একটি
নফ্স বা রিপুর
বিরুদ্ধে, অপরটি কাফেরদের
বিরুদ্ধে। আর আপনি
তাঁরই বংশধর বলে
পরিচয় দিলেন ; কিন্তু
বলুন ত, আপনি
কোন তরবারি পরিচালনা
করেন ?” সৈয়দ সাহেব
একথা শুনে নিজেকে
সামলাতে না পেরে
মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে
কাঁদতে লাগলেন আর
বললেন, “হে শেখ
সাহেব, আমার হ্জ্জ
এ স্থানেই ছিল।
দয়া করে আমাকে
আল্লাহ্ পাকের দিকে
পথ দেখিয়ে দিন”।
জুনায়েদ বললেন, “আপনার
সিনা আল্লাহ্ পাকের
খাস হারেম (পবিত্র গৃহ)।
কাজেই তাতে পারতপক্ষে
তাতে কোন গায়ের
মাহরমকে (অযাচিত কাউকে) স্থান
দিবেন না।” জুনায়েদের
নসীহত শেষ না
হতেই সৈয়দ সাহেব
দুনিয়া ছেড়ে চলে
গেলেন। তাঁর উক্তিসমূহ
এতই উচ্চভাব এবং
গূঢ়তত্ত্বে পূর্ণ ছিল।
বর্ণিত
আছে যে, এক
যুবক জুনায়েদ বাগদাদীর
মুরীদদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে
কয়েকদিন পযর্ন্ত নামাযের
সময় ছাড়া অন্য
কোন সময় বিছানা
থেকে মাথা উঠাতেন
না। জুনায়েদ একজন
মুরীদকে হুকুম করলেন
যে, তাঁর পিছনে
পিছনে যাও এবং
তাঁকে জিজ্ঞেস কর
যে, “সুফী ত
সাফা বা শুদ্ধির
গুণে গুণী। তবে
সেই ব্যক্তি তাঁকে (আল্লাহ্কে) কিভাবে
পাবে যে কোন
গুণের অধিকারী নন ?”
হুকুম মতো সে
মুরীদ যুবককে জিজ্ঞেস
করলে তিনি উত্তরে
বললেন, “নিজে গুণহীন
হয়ে যাও, তবেই
অসীম গুণময়কে (আল্লাহ্কে)
পাবে”। জুনায়েদ এই
উত্তর শুনে একথার
গুঢ়তত্ত্বে ডুবে গেলেন
এবং বলতে লাগলেন,
“হায়, সে ছেলেটি
এমন এক নিয়ামত
ছিল যার তুলনা
নেই। তোমরা তাঁর
উপযুক্ত সম্মান করলে
না।”
একবার এক ব্যক্তি
জিজ্ঞাসা করলেন, “বান্দা
কখন গোলামের হাকীকত
বুঝতে সক্ষম হয় ?”
উত্তরে বললেন, “যখন
বান্দা প্রত্যেক বস্তুর
মালিক একমাত্র আল্লাহ্
পাককেই জানে, দুনিয়ার
সমস্ত বস্তুর প্রকাশ
একমাত্র আল্লাহ্ পাক
হতে বলে সুদৃঢ়
বিশ্বাস রাখে, সকল
বস্তুর অস্তিত্ব লাভ ও স্থায়িত্ব
আল্লাহ্র হাতে এবং
মনে প্রাণে বিশ্বাস
রাখে যে, প্রত্যেকের
প্রত্যাবর্তন স্থলও একমাত্র
আল্লাহ্ পাকের দিকেই ;
তখনই তার দাসত্বের
স্বরূপ প্রকাশ পায়
এবং সে দাসত্বের
শ্রেণীভুক্ত হয়।” লোকে সততা সম্পর্কে
জিজ্ঞাসা করল। তিনি
উত্তরে বললেন, “সত্যবাদীর
গুণের নাম সততা।
সত্যবাদী ঐ ব্যক্তিকে
বলে, যাকে তুমি
যেরূপ গুণসমূহে গুণী
বলে শুনেছে, কাজের
বেলায়ও সেরূপ দেখতে
পাও এবং সারাজীবনই
ঐরূপ দেখতে পাও।
আর যে ব্যক্তিকে
কথায়, কাজে ও
অবস্থায় সৎ দেখতে
পাও, তাকে সিদ্দিক
বলিও।” লোকেরা জিজ্ঞেস
করলো, “এখ্লাস (অান্তরিকতা) কি ?”
উত্তরে বললেন, “আল্লাহ্
পাকের কাজ করতে
নফ্সকে (প্রবৃত্তি) করে দেওয়া ;
কেননা, এটাও তোমার
উপরে প্রভুত্ব করতে
চায়। অর্থাৎ সমস্ত
কাজ একমাত্র আল্লাহ্র
খুশীর জন্য করা
এবং তা হতে
আপনার দখল না
দেওয়া। কেননা, নফ্সের
স্বভাবই হল প্রভুত্বের
দাবীতে তোমাকে তার
অনুগত রাখা”।
এক
ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল,
“খওফ (ভয়) কি’’ ? উত্তরে
বলেন, “প্রতি মুহূর্তে
আযাবের আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত
থাকা”। জিজ্ঞেস করা
হলো, “শাফ্কাত কি ?”
উত্তরে বললেন, “কোন
ব্যক্তি খাস অন্তরে
কোন বস্তু চাইলে
তাকে তা দান
করা কিন্তু ইহার
ইহ্সান বা প্রতিদান
না চাওয়া”। জিজ্ঞেস
করা হলো, “নির্জনতা
অবলম্বন করা কখন
কর্তব্য ?” উত্তরে বললেন,
“যখন তোমার নফ্স
হতে নির্জনতা হাসেল
হয় অর্থাৎ নিজকে
নফ্সের কবল-মুক্ত রাখতে
পার”। এক ব্যক্তি
জিজ্ঞেস করল, “সবচেয়ে
শ্রেষ্ঠ বুযুর্গ ও
খোদাপ্রেমিক কে ?” উত্তরে
বললেন, “যে দরবেশ
আল্লাহ্র খুশীতে খুশী
থাকেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ
বুযুর্গ”। জিজ্ঞেস করা
হলো, “কি ধরনের
লোকের সাহচরযে থাকব”?
উত্তরে বললেন, “যে ব্যক্তি উপকার
করে তা মনে
রাখে না এবং
তুমি কোন অপরাধ
করে ক্ষমা চাইলে
তা ক্ষমা করে
দেন”। জিজ্ঞেস করা
হলো, “কান্নার চেয়েও
উত্তম বস্তু আছে
কি”? উত্তরে বললেন,
“হ্যাঁ, কান্নার উপরে
কান্না”। জিজ্ঞেস করা
হলো, “বান্দা কে ?”
উত্তরে বললেন, “যে
অন্যের বন্দেগী হতে
মুক্ত অর্থাৎ যে
অন্যের বন্দেগী করে
না”। এক ব্যক্তি
জিজ্ঞেস করল, “মুরীদ
কে ?” উত্তরে বললেন,
“যে ইল্মের প্রহরায়
থাকে এবং আল্লাহ্
তাআলার আশ্রয়ে থাকে,
তাকে মুরীদ বলে।”
লোকে জিজ্ঞেস করল,
“তাওয়ায্যো (দীনতা) কি ?” উত্তরে
বললেন, “মাথা নত
রাখা আর মাটিতে
শয়ন করা”। তিনি
বলতেন, “হে আল্লাহ্,
কিয়ামতের দিন আমাকে
অন্ধ করে উঠাবে ;
কেননা যে তোমাকে
না দেখে তার
পক্ষে অন্ধ থাকাই
শ্রেয়। তা হলে
সে অপর কাউকেও
দেখতে পাবে না”।
যখন
জুনায়েদের ওফাত (মৃত্যুক্ষণ) নিকটবর্তী
হল, তখন মুরীদদেরকে
হুকুম করলেন, “আমাকে
ওজু করাও”। কথামতো
মুরীদরা তাঁকে ওজু
করাল বটে, কিন্তু
ভুলক্রমে আঙ্গুল খেলাল
না করায় পরে
তিনি তাদেরকে স্মরণ
করিয়ে দিলে তারা
আবার খেলাল করিয়ে
দিল। তারপর তিনি
সিজ্দায় পরে অঝোরে
কাদঁতে লাগলেন। লোকেরা
বলল, “হে তরীকতের
সরদার ! জীবনভর এতো
সিজ্দা, এতো ইবাদত
করলেন, এখন এই
শেষ মুহূর্তেও সিজ্দা ?
এটা কি সিজ্দার
সময় ?” উত্তরে বললেন,
“যেহেতু এই সময়
হতে জুনায়েদ আর
কখনও অধিক মোহতাহ্
বা মুখাপেক্ষী হয়
নি”। কিছুক্ষণ পর
তিনি কোরআন শরীফ
তেলাওয়াত আরম্ভ করলেন।
এক মুরীদ আরয
করল, “আপনি কোরআন
শরীফ পড়ছেন ?” তিনি
উত্তরে বললেন, “আমার
পক্ষে ইহা অপেক্ষা
উত্তম সময় আর
কি হতে পারে ?
আমার সময় খুবই
কম ; অল্পক্ষণ পরেই
আমার আমলনামা গুটিয়ে
ফেলা হবে। আমি
নিজ চক্ষে দেখছি,
আমার ৭০ বছরের
ইবাদত শূণ্যে একটি
চুলের ন্যায় সূক্ষ্ম
ডুরিতে ঝুলছে এবং
একটি ঘূর্ণী বায়ু
তাকে ঘুরাচ্ছে। আমি
জানি না, এই
বায়ু প্রবাহ কি ?
তা কি মিলন
ঘটাবে না বিচ্ছেদ ?
আবার একদিকে নজর
করলে দেখি পুলসেরাত
এবং অপরদিকে মালাকুল
মওত। সেই সাথে
কাজীকে দেখছি, যাঁর
গুণ সুবিচারময়। তিনি
আমার প্রতি তাকাচ্ছেনও
না। আমার সামনেই
রয়েছে একাধিক পথ
কিন্তু আমি জানি
না তিনি আমাকে
কোন্ পথে নিয়ে
যাবেন।”
তখন তাঁর অবস্থা
খুবই সংকটাপন্ন হয়ে
পড়ল। তিনি বিচলিত
হয়ে ক্রমে মুমূর্ষ
অবস্থায় পৌঁছলেন। তৎপর
জুনায়েদ কোর্আন শরীফ
খতম করলেন এবং
সুরায়ে বাকারার ৭০
আয়াত পাঠ করলেন।
এক ব্যক্তি বললেন,
“আল্লাহ্ আল্লাহ্ বলুন”।
উত্তরে বললেন, “আমাকে
স্মরণ করিয়ে দিতে
হবে না- আমি সেই
পরম বন্ধুকে ভুলিনি”।
তারপর তিনি আঙ্গুলের
কড়ে “সোবহানাল্লাহ্” পড়তে
লাগলেন। পড়তে পড়তে
শাহাদাত আঙ্গুল পযর্ন্ত
পৌঁছলে তা উর্ধ্বপানে
তুলে ধরে বললেন,
“বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহিম”
এবং চক্ষু মুদিলেন।
এভাবেই জুনায়েদ স্বীয়
পরম মাশুকের সাথে
মিলিত হলেন। গোসল
দেওয়ার সময় গোসল-দাতারা
তাঁর চোখে পানি
ঢালতে চাইলেন। হঠাৎ
গায়েবী আওয়াজ হলো,
“আমার বন্ধুর চক্ষু
হতে তোমাদের হাত
দূরে রাখ। কেননা,
আমার নাম জিক্র
করতে করতে যে
চক্ষু বন্ধ হয়েছে,
সে চক্ষু আমার
দর্শন ব্যতীত খুলবে
না”। অতঃপর গোসলদাতাগণ
তাঁর চক্ষু হতে
হাত দূরে রেখেই
গোসল শেষ করলেন।
তারপর বাঁকা আঙ্গুলগুলো
খুলতে চাইলেন বটে,
কিন্তু পারল না।
আওয়াজ আসল, “যে
হাতের আঙ্গুল আমার
নামের তাস্বিহ পড়তে
পড়তে বন্ধ হয়েছে
তা আমার হুকুম
ছাড়া খুলবে না।”
তারপর যখন তাঁর
পবিত্র লাশের জানাযা
তৈরী হল, তখন
একটি সাদা কবুতর
এসে জানাযার একপাশে
বসে থাকল। এক
ব্যক্তি এটাকে তাড়াবার
যথেষ্ঠ চেষ্ঠা করল, কিন্তু কবুতর
উড়ল না। সে
বলে উঠল, “আমাকে
তোমরা কষ্ঠ দিও না-
নিজেরাও বৃথা কষ্ঠ
করো না। কেননা,
আমার নিম্নভাগ তো
কোন প্রেম-প্যারেকে খাটের
সাথে আবদ্ধ। আর আজ তোমাদের
জানাযা উঠানোর কষ্ঠ
স্বীকার করতে হবে
না। কেননা, আজ
হযরত জুনায়েদের লাশ
ফেরেশতাদের ভাগে পড়েছে।
তোমরা এখানে গন্ডগোল
না করলে এই
পবিত্র লাশ বাজপাখীর
আকারে আকাশে উড়ত।”
হযরত
জুনায়েদের ওফাতের পর
এক ব্যক্তি তাঁকে
স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞেস
করলেন, “আপনি মোনকার-নাকীর
ফেরেশতাদের সওয়ালের কি
জওয়াব দিয়েছেন ?” উত্তরে
বললেন, “যখন সেই
দুই ফেরেশতা আল্লাহ্
জাল্লা জালালুহুর দরবার
হতে জাঁকজমকের সাথে
আমার কাছে হাজির
হলেন এবং জিজ্ঞেস
করলেন, “তোমার প্রভু
কে ?” আমি ঈষৎ
হেসে বললাম, “যখন
সে মহাপ্রভু প্রশ্ন
করেছিলেন (আমি কি
তোমাদের প্রভু নই ?)
তখনই ত আমি
জওয়াব দিয়েছিলাম (হ্যাঁ) ;
এখন তুমি আবার
এসেছ প্রশ্ন করতে
যে, “তোমার প্রভু
কে ?” যে বাদ্শার
সওয়ালের জওয়াব দিয়েছে,
তাঁর আবার গোলামের
জওয়াব দিতে ভয় কি
? যাক
শোন, আমি আজ
প্রভুর ভাষাতেই ইহার
জওয়াব দিচ্ছি, “প্রভু
ঐজন, যিনি আমাকে
সৃষ্ঠি করেছেন, পরে
তিনি আমাকে জীবন-পথে
নিয়ে থাকেন”। ফেরেশতাদ্বয়
উত্তর শুনে সসম্ভ্রমে
উঠে পরস্পর এ
বলতে বলতে চলে
গেলেন যে, “ইনি
ইশ্কের নেশায় এখনও
মস্ত হয়ে আছেন”।
হযরত হারীরী (রহঃ) বলেন,
“আমি জুনায়েদ (রহঃ) কে
স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞেস
করলাম, “আল্লাহ্ পাক
আপনার সাথে কিরূপ
ব্যবহার করেছেন ?” তিনি
উত্তরে বললেন, “রহম
করেছেন এবং মা’ফ
করে দিয়েছেন। আর
সেই দুই রাকাত
নামায, যা মধ্যরাত্রিতে
নিয়মিত পড়ার আমার
অভ্যাস ছিল, তা
ছাড়া আর কোন
কিছুই আমার কাজে
আসেনি”।
অমিয় বাণী
১। সাধনার
পথে অনেক ডাকাত
ওৎপেতে আছে। তারা
এই পথে নানা
প্রকারের জাল বিস্তার
করে রাখে। ধোঁকার
জাল, মোহের জাল,
শক্তির জাল, অনুগ্রহের
জাল ইত্যাদি এমন
অসংখ্য জাল রয়েছে,
যার ইয়ত্তা নাই।
কাজেই এই পথের
পথিককে এমন বীরপুরুষ
হতে হবে যেন
বিভিন্ন জালের ভিতরের
প্রভেদ বুঝতে পারে।
২। সাধক
আল্লাহ্ প্রেমে অস্থির
হয়ে যে আক্ষেপের
সুদীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন,
তা মানুষ ও
আল্লাহ্র মধ্যকার পরদাসমূহ
জ্বালিয়ে দেয়।
৩। যে
ব্যক্তি জীবনে একবারও
নিজের অন্তরে আল্লাহ্
পাককে পেয়েছে, সে-ই
প্রকৃত সুখী।
৪। আল্লাহ্পাক
তাঁর বান্দাকে দুই
ইল্মে (জ্ঞানে) আলেম দেখতে
চান ঃ (১) অবুবিয়াত
বা দাসত্ব জ্ঞানের
ইল্ম ; (২) রবুবিয়াত
বা আল্লাহ্তত্ত্ব জ্ঞানের ইল্ম।
অন্যান্য ইল্ম দুনিয়ার
সুখ-ভোগের উদ্দেশ্যের মধ্যে
গণ্য।
৫। তৌহিদের (একত্ববাদের) ময়দানে
চিন্তায় বিভোর থাকাই
আল্লাহ্ পাকের সাথে
শ্রেষ্ঠতম সম্পর্ক।
৬। হযরত
মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) যে-পথ
দেখিয়ে গিয়েছেন, তাই
চলার পথ। এ
পথ ছাড়া মানুষের
পক্ষে অন্য সমস্ত
পথ নিষিদ্ধ।
৭। যে
ব্যক্তি পাক কোরআনের
নির্দেশ মানে না
এবং হযরত মোহাম্মদ
(সাঃ)-এর শিক্ষা জানে
না, কখনও তোমরা
তার পদাঙ্ক অনুসরণ
করো না। কেননা,
এই ব্যক্তি অজ্ঞ।
কারণ, জ্ঞান কেবলমাত্র
কোরআন ও হাদীসের
ভেতরেই সীমাবদ্ধ।
৮। মানুষ
সৎস্বভাবের দ্বারা হয়,
আকৃতি দ্বারা নয়।
৯। যে
ব্যক্তি আল্লাহ্ পাককে
অপরিজ্ঞাত বলে, সে
মিথ্যুক।
১০। যে
ব্যক্তি আল্লাহ্ পাককে
চিনতে পারে না,
সে কখনও সুখী
হতে পারে না।
১১। যতদূর
সম্ভব চেষ্ঠা করবে
যেন তোমার ঘরের
সমস্ত মালপত্র মাটির
তৈরী হয়।
১২। সে-ই
প্রকৃত বান্দা যে
খিদমতে ত্রুটি না
করে, কোন বিষয়ে
অভিযোগ না করে
এবং ভাই-বন্ধু এলে
তাদের সামনে নফল
ইবাদত বন্ধ রাখে।
১৩। আমি
সত্য বলছি, আল্লাহ্ তাআলা আপন
বান্দার সাথে আখিরাতে
সেরূপ ব্যবহার করবেন,
বান্দা পূর্বাহ্নে যেরূপ
করে যাবে।
১৪। আল্লাহ্
তাআলা আপন বান্দাকে
যত কাছে দেখেন,
ততই নিজে তার
অন্তরের নিকটবর্তী হন।
১৫। আলেমদের
সমস্ত বিদ্যা দুই
শব্দে নিবদ্ধ ঃ (১)
জাতির সংশোধন (২)
খাঁটি জনসেবা।
১৬। যার
জীবন শ্বাসের উপরে
নির্ভর করে, তার
শ্বাস বের হয়ে
গেলেই মৃত্যু। আর
যার জীবন আল্লাহ্
তাআলায় আবদ্ধ, তার
মৃত্যু হইল স্বাভাবিক
জীবন হতে প্রকৃত
জীবনের দিকে ফিরে
যাওয়া এবং এটাই
আসল হায়াত বা
অনন্ত জীবন।
১৭। যে চক্ষু আল্লাহ্
পাকের সৃষ্ঠবস্তুকে শিক্ষণীয়
বিষয়রূপে না দেখে,
তার পক্ষে অন্ধ
হওয়াই শ্রেয়। যে
জিহ্বা আল্লাহ্ তাআলার
জিক্র করে না,
তার বোবা হওয়াই
শ্রেয়। যে কান
আল্লাহ্ পাকের সত্য
কালাম শুনতে অভ্যস্ত
নয়, তার বধির
হওয়াই শ্রেয়। যে
শরীর প্রতিপালকের ইবাদতে
কোন কাজে লাগে
না, তার মৃত্যুই
শ্রেয়।
১৮। পীরের
কাছে মুরীদের প্রথমে
নামাযের বিষয়সমূহ ছাড়া
অন্য কিছুই শিক্ষা
করা উচিত নয় ;
এজন্য ভালোরূপে সুরায়ে
ইখলাস এবং সুরায়ে
ফাতিহা শেখাই যথেষ্ঠ।
১৯। যে
ব্যক্তি খাবার খাওয়ার
ভাণ্ড সামনে রেখেছে,
সে মোনাজাতের স্বাদ
কখনও পেতে পারে
না।
২০। তোমরা
দরবেশ সাজিয়াছ এবং
এজন্য লোকেরাও তোমাদের
সম্মান করে। কিন্তু
ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা
করে দেখ, আল্লাহ্
পাকের সাথে নির্জনে
তোমাদের সম্পর্ক কিরূপ !
২১। যারা
নেক্ কাজে সাহসী
এবং অটল, তারাই
চক্ষুষ্মান। আর যাদের
কেবল ইচ্ছা আছে
কিন্তু কাজের সাহস
নেই, তারা অন্ধ।
২২। যখনই
তুমি নিজ অন্তরকে
খোঁজ করবে, তখনই
তাকে আল্লাহ্ পাকের
দাসরূপে পাবে।
২৩। সাধক
যখন আল্লাহ্ পাকের
ইশ্কে নিজেকে হারিয়ে
ফেলে, তখন সে
দিনে হাজার বারও
মরতে প্রস্তুত হয়।
২৪। নবীগণের
উক্তি আল্লাহ্ তাআলার
প্রত্যক্ষ সংবাদ আর
সিদ্দিকগণের উক্তি আল্লাহ্
পাকের নূর দর্শনের
আভাস মাত্র।
২৫। সুফীরা
জমীনের মত ; সকল
আবর্জনা তার উপরই
ফেলা হয়। আবার
ইহার ভেতর হতেই
সকল সতেজ ও
শস্য-শ্যামলা উদ্ভিদরাজি উৎপন্ন
হয়ে থাকে।
২৬। আল্লাহ্
পাকের জিক্রের সমষ্ঠি,
তাঁর হুকুম মান্য
করার প্রেরণা ও
পায়রবী দ্বারা তা
আমল করাকেই তাসাওফ
বলে।
২৭। তাসাউওফ
শব্দ ‘এসতেফা’ হতে
উৎপন্ন যার অর্থ
বাছাই করা এবং
পবিত্র। অতএব যে
ব্যক্তি এক আল্লাহ্
ছাড়া অন্য কারও
স্মরণ হতে পবিত্র,
তাকেই সুফী বলে।
২৮। সমস্ত
সম্পর্ককে ছিন্ন করে
একমাত্র আল্লাহ্পাকের মধ্যে
নিজকে ডুবিয়ে দেয়ার
নামই তাসাউওফ বা
তরীকত।
২৯। এক
আল্লাহ্র জিকির করতে
করতে বিভোর হয়ে
অন্য কোন দিকে
মন না দিয়ে
আল্লাহ্র যিক্রে নিজেকে
বিলিয়ে দেওয়ার নামই
তরীকত।
৩০। মা’রিফাত
দুই প্রকার ; যথা ঃ- (১)
মা’রিফাতে তাসাউওফ অর্থাৎ
মানুষের নিজের ইচ্ছায়
আল্লাহ্ পাকের সাথে
প্রেম করা ; আর
(২) মা’রিফাতে আয়ার্রুফ
অর্থাৎ আল্লাহ্ পাকের
নিজের ইচ্ছায় মানুষের
সাথে প্রেম করা।
৩১। ইল্ম
ও মা’রিফাত উভয়ই
মুহীত (সীমাবদ্ধ) বস্তু।
ইল্ম (জ্ঞান) আল্লাহ্ পাককে
চেনার জন্য এবং
মা’রিফাত বান্দার নিজকে
চেনার জন্য। উভয়টিই
সীমাবদ্ধ ; তাই যখন
এই সীমাবদ্ধ ইল্ম
এই সীমাবদ্ধ মা’রিফাতে
ডুবে যায়, তখন আর পরস্পরের
শির্ক (অংশীবাদ) থাকে না।
৩২। ইশ্ক
আল্লাহ্ পাকের একটি
আমানত মাত্র। যে ইশ্ক গরযের (স্বার্থ) জন্য
হয়, গরয হাসিল
হলে আর সে ইশ্ক থাকে
না।
৩৩। মানুষ
যে পযর্ন্ত আল্লাহ্
তাআলার পথে জান
কুরবান না করে,
সে পযর্ন্ত আল্লাহ্
পাকের মহব্বত হাসিল
করা তার পক্ষে
সম্ভবপর নয়। লোকে
জিজ্ঞেস করল, “মোরাকাবা
এবং লাজ্জাত-এই দুয়ের
মধ্যে প্রভেদ কি ?”
উত্তরে বললেন, “মোরাকাবা
হলো গায়েবী বস্তু
পাওয়ার জন্য প্রতীক্ষা
করা আর লাজ্জাত
হলো উপস্থিত ক্ষেত্রে
শরম দেখানো।”
৩৪। অবুদিয়াত (দাসত্ব) দুটি
স্বভাবের মধ্যে পাওয়া
যায় ঃ (১) ভিতরে
বাহিরে আল্লাহ্ পাকের
সাথে সততা রক্ষা
করা (২) সব
কাজে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর অনুসরণ
করা।
৩৫। স্বাদে
তৃপ্তি এবং চেষ্ঠায়
বিশ্বাস- এই দুটিকে
ত্যাগ করতে পারলেই
দাসত্বের হক আদায়
হবে।
৩৬। নিজেকে
নেয়ামতের উপযুক্ত বলে
ধারণা না করাই
শোক্র।
৩৭। যে
স্থলে মিথ্যা না
বললে রক্ষা পাওয়া
যাবে না, সেই
স্থলেও যিনি সত্য
বলেন, তাঁরই প্রকৃত
সত্যনিষ্ঠা আছে।
৩৮। সত্যকে
খুজেঁ পায় নি, এমন লোক
দুনিয়ায় নেই।
৩৯। খাঁটি
ফকীরের চিহ্ন এই যে, কাউকেও
প্রশ্ন করবে না
এবং কারও সাথে
ঝগড়া করবে না।
কেউ ঝগড়া করলেও
চুপ করে থাকবে।
৪০। সবরের (ধৈর্যের) শেষ
পযার্য়ই হলো তাওয়াক্কোল (আল্লাহ্র ওপর
ভরসা)। আল্লাহ্র প্রতি
সব কাজে নিরর্ভরতার
দ্বারাই ধৈর্য পূর্ণতা
পায়।
৪১। সবর
(ধৈর্য) মানুষকে বিনা
প্রার্থনায় এবং বিনা
মিনতিতে আল্লাহ্ পাকের
সাথে সবর্দা লিপ্ত
রাখে।
৪২। তিক্ত
জিনিস আহার করে
মুখ বিকৃত না
করার নামই সবর
এবং না খেয়েও
খাওয়ার মতো ভাব দেখানোকেই বলে
তাওয়াক্কোল।
৪৩। রোযগার
না করার নাম
তাওয়াক্কোল নয় বরং
আল্লাহ্ তাআলার ওয়াদায়
মনে সুদৃঢ় বিশ্বাস
রাখার নামই তাওয়াক্কোল।
৪৪। উভয়
জাহানের কারও চাইতে
নিজেকে শ্রেষ্ঠ না
জানা এবং একমাত্র
আল্লাহ্ তাআলা ছাড়া
অপর কারও মুখাপেক্ষী
না হওয়াই ‘তাওয়ায্যো’ (নম্রতা)।
৪৫। চারিটি
বস্তুর নাম সৎস্বভাব ঃ- (১) ছাখাওয়াত (বদান্যতা) (২)
মহব্বত (৩) নসীহত
ও (৪) অনুগ্রহ।
৪৬। আল্লাহ্
পাকের নেয়ামত (অনুগ্রহ) এবং তৎসঙ্গে
নিজ অপরাধের কথা
চিন্তা করলে যে
অবস্থা হয়, তাই
হায়া বা লজ্জা।
৪৭। আপন
এখতিয়ারকে (ইচ্ছা) ভুল
করে আল্লাহ্র ইচ্ছার
ওপর নিজকে ছেড়ে
দেওয়ার নাম রেযা (সন্তুষ্টি)।
৪৮। তওবার
তিন অবস্থা ঃ (১)
আল্লাহ্ পাকের কাছে
লজ্জিত হওয়া, (২)
গুণাহ পরিত্যাগ করার
দৃঢ় সংকল্প করা,
(৩) নিজেকে জুলুম
এবং ঝগড়া থেকে
বিরত রাখা।
হযরত ইমাম
সাদিক (রহঃ)
হযরত
ইমাম জাফর সাদিক
হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর চাচাত
ভাই ও জামাতা
হযরত আলী কার্রামাল্লাহুর বংশধর।
তিনি ছিলেন ‘আহলে
বায়ত”-এর মধ্যে প্রখ্যাত
বার ইমামের অন্যতম।
তিনি ‘আহলে বায়ত’-এর
ভক্তি ও প্রেম
সম্পর্কে কবিতায় বলেন ঃ-“রাসুলুল্লাহর পরিবার
পরিজনকে ভালবাসলেই কেউ
যদি রাফেযী হয়ে
যান, তাহলে মানুষ
ও জিনের সাক্ষী
থাকা উচিত, সত্যিই
আমিও একজন রাফেযী”।
তিনি কুরআন, হাদীস ও ইলমে মা’রিফাতে
একজন বিশেষ তত্ত্বজ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন।
হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর প্রথম ভাগে খলীফা মানসূর বাগদাদের সিংহাসনের সমাসীন হন । তিনি হযরত সাদিকের
বিরাট ব্যক্তিত্ব ও তাঁর প্রতি মানুষের
অগাদ ভক্তি ও ভালবাসা দেখে অত্যন্ত চিন্তিত ও ভীত হন। তাই উযীরকে বলেন , “হে উযীর ! সাদিককে ধরে নিয়ে
এসো, আমি তাকে হত্যা করব”। উযীর বিনীত
ভাবে আরয করেন, “তিনি নিরিবিলি নির্ঝনঝাট ইবাদতে মশগুল; সংসার থেকে একেবারেই
মুক্তি হয়ে আছেন, তাঁর প্রতি ক্রাধ প্রকাশ করলে আপনার কি লাভ হবে ?” খলীফা বলেন,
“যাই হোক না কেন, তাঁকে আমার দরবারে আনতেই হবে।” উযীর পুনঃপুনঃ নিষেধ-অনুরোধ করেও
যখন খলীফার মনের গতি ফিরাতে পারলেন না, তখন হযরত সাদিককে ডাকতে গেলেন। খলীফা
চাকর-নফরদেরকে ডেকে বলেন, “যে মুহূতে সাদিককে দরবারে হাযির করা হবে, আমি তখনই
মাথার তাজ খুলে ফেলব। ঠিক তখনই তোমরা
সাদিকের মস্তক দু টুকরা করে ফেলবে।” হযরত সাদিক যথাসময়ে খলীফা মানসূরের দরবারে
পৌছুলে মানসূর বিনীতভাবে হাঁটু নত করে সাদিককে নিজের তখতে বসালেন। ভৃত্যরা
এতদর্শনে অত্যন্ত অবাক হল। মানসূর হযরত
সাদিককে বললেন, “আপনি
আমার কাছে কি চান
?” সাদিক
উত্তরে বললেন, “আমাকে ডেকে
আমার ইবাদতে বিঘ্ন সৃষ্ঠি
করবেন না, এটাই আমি
চাই।” খলীফা মানসূর সসম্মানে তখনই তাঁকে বিদায় দিলেন । এর পরক্ষণেই খলীফা
মানসূরের কম্পন শুরু হয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় তাঁর তিন ওয়াক্ত নামায
ক্বাযা হয়। খলীফার জ্ঞান ফিরলে উযীর জিজ্ঞাস করেন, “আপনার এ অবস্থা হল কেন’’?
খলীফা বলেন, “যখন হযরত সাদিক আমার দরজায় প্রবেশ করেন, তখন তাঁর সাথে আমি একটি অজগর
দেখলাম। অজগরটি যেন ফণা বিস্তার করে আমাকে বলেছিল,”হে মানসূর! যদি তুমি সাদিককে
কষ্ট দাও, আমি তোমাকে দংশন করব।” তার ভয়ে আমি হযরত সাদিকের খিদমতে ওযর-আপত্তি
জানিয়ে মা’ফ চেয়ে বিদায় জানাই এবং ভয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়লাম।”
হযরত দাঊদ তায়ী একদিন হযরত সাদিকের
কাছে এসে বলেন যে, তাঁর অন্তঃকরণ কাল হয়ে গেছে। এ বলে তিনি নসীহত করার জন্য অনুরোধ
করলে হযরত সাদিক বলেন, “সোলায়মান ! তুমি বতর্মান সময়ের একজন যাহেদ! আমার নসীহতে
তোমার কি প্রয়োজন?” সোলায়মান বলেন, “হে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বংশধর ! আপনি
বতর্মানে দুনিয়ার সকল মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তাই আমাদেরকে নসীহত করা আপনার উপর
ওয়াযিব”। হযরত সাদিক বলেন, “হাসাব-নাসাব দ্বারা নসীহত হয় না, ‘আমল’(কর্ম) দ্বারাই
সত্যকে বুঝতে পারা যায়। কিয়ামতের দিন যদি আমাকে নানাজি জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কেন
আমার তাঁবেদারি করলে না ? তখন আমি কি উত্তর দেব? এ ভয়ে আমি কম্পিত। “সোলায়মান
কেঁদে বললেন, “হে আল্লাহ, তোমারই নবীর রক্তের মিশ্রণে যাঁর শরীর গঠিত, যাঁর চরিত্র
রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর চরিত্রের আর্দশে গঠিত, যাঁর নানাজি আল্লাহ্র রাসূল, মা
আদর্শ মহিলা, তিনি যখন নিজ আমল সমন্ধে এতটা ভীত ও সন্ত্রস্ত, তখন দাঊদ এমন আর কোন্
মানুষ যে আপন আমলে খুশী হবে ?”
একদিন হযরত সাদিক বন্ধুদেরকে বলেন,
“আসুন, আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করি- আমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন মুক্তি
পাবে, সে অপরের গুনাহ্ মাগফেরাতের জন্য আল্লাহ্ পাকের দরবারে সুপারিশ করবে।” তাঁরা
বলেন, হজরত সাদিক! আমাদের এ প্রকার প্রতিজ্ঞার কি প্রয়োজন ? আপনার নানাজি স্বয়ং
সুপারিশকারী।” হযরত সাদিক উত্তরে বললেন, “আমি নিজের কাজের জন্য হাশরের দিন নানাজির
প্রতি দৃষ্টিপাত করতে লজ্জাবোধ করি ; তাই আপনাদের কাছে আরয করেছিলাম।” একদিন হযরত
সাদিককে মূল্যবান পোশাক পরান হয়েছিল। তা দেখে এক ব্যক্তি বলল, “আপনি নবীর বংশধর।
এরূপ সুকোমল মূল্যবান পোশাক ব্যবহার করা আপনাকে মানায় না।” হযরত সাদিক নিজের
আস্তিনের ভিতরের দিকে দেখার জন্য তাকে ইঙ্গিত করেন। আস্তিনের নীচে মোটা কাপড় খসখসে
বোধ হল। তিনি বলেন, “আমার একটি জামা আল্লাহ্ তাআলার দরবারে নামায পড়ার জন্যও অপরটি
মানব সমাজে চলাফেরার জন্য।’’
একদিন এক ব্যক্তি হাজার টাকার একটি
থলে হারিয়ে ভুলক্রমে হযরত সাদিককে আক্রমণ করে। সে ব্যক্তি হযরত সাদিককে
চিনত না। সাদিক বলেন, “কত টাকা ছিল ?” সে বলল, “হাজার টাকা”। পরে লোকটি টাকা
পেয়ে হযরত সাদিককে টাকাগুলো ফেরত নিয়ে এল। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ না করে বললেন,
“আমি যা দান করেছি তা পুণরায় গ্রহণ করব না।” লোকটি হযরত যা’ফর সাদিককে চিনতে পেরে
খুবই লজ্জিত হল। একদিন হযরত সাদিক কোন এক পথ দিয়ে ‘আল্লাহ্ আল্লাহ্’ যিক্র করতে
করতে যাচ্ছিলেন। তখন একজন ভিক্ষুক ‘আল্লাহ্ আল্লাহ্’ বলতে বলতে তাঁর পিছনে ছুটল।
হযরত সাদিক বললেন, “আল্লাহ ! পরনে কাপড় নেই, গায়ে চাদরও নেই।“ হঠাৎ অদৃশ্য থেকে
কয়েকখানা মূল্যবান কাপড় পেয়ে তা পরিধান করলেন। এ দেখে সাথের দুঃখী ব্যক্তি বলল,
আল্লাহ্র যিক্র এ আমিও আপনার সাথে শরীক ছিলাম, অতএব আপনার পুরাতন কাপড় আমাকে দান
করুন।” হযরত সাদিক তৎক্ষণাৎ তাকে পুরাতন জামা সদকা করে দিলেন।
এক ব্যক্তি হযরত সাদিককে কাছে
এসে বলে, “আমি আল্লাহকে দেখতে চাই, তাঁকে আমার কাছে হাযির করুন।” হযরত সাদিক বলেন,
“তুমি কি শুন নাই যে, আল্লাহ্ মূসা (আঃ)-কে বলেছিলেন- তুমি কখনই আমাকে দেখতে পাবে
না।” সে বলল, “হাঁ, তবে এটা মুহাম্মদ (সাঃ)-এর দীন ইসলাম, হযরত মূসার যুগ অতীত হয়ে
গেছে। তাছাড়া মিল্লাতে মুহাম্মদীর গন্ডির ভিতরে থেকে কোন এক ওলী বলতেন, “আমার
অন্তর আমার রব্কে দেছেছে”। তা শুনে অপর এক অলী চীৎকার করে বলে উঠল, “তাঁকে না
দেখে আমি রবের ইবাদত বন্দেগি করি না।’’ তা শুনে হযরত সাদিক মুরিদগণকে বললেন, “একে
বেধেঁ নদীতে ফেলে দাও।” তাঁকে নদীতে ফেলে দেয়া হল। “হে রাসূলুল্লাহর বংশধর, আমাকে
সাহায্য করুন’’ বলে সে কাঁদতে থাকে। তখন তাঁকে উঠিয়ে এনে পুণরায় পানিতে ফেলা হল।
প্রত্যেকবার পানিতে ফেলা হলে তিনি এরূপ সম্বোধন করতে থাকেন। অবশেষে যখন অতল পানিতে
ডুবে মরণাপন্ন হল, তখন তিনি ‘আল্লাহ্ আল্লাহ্’ বলে চীৎকার করেন। হযরত সাদিক বলেন,
“তাঁকে উঠিয়ে আন’’। কিছুক্ষণ পর হযরত
সাদিক জিজ্ঞেস করেন, “কেমন, আল্লাহ্কে দেখেছ ?” তিনি উত্তর বলেন, “যতক্ষণ অপরের
সাহায্য চেয়েছিলাম ততক্ষণ পর্দার আড়ালে ছিলাম। কিন্তু যখন খাঁটি মনে আল্লাহ্র
সাহায্য চেয়েছি, তখন অন্তরের দুয়ার খুলে গিয়ে রহমতের নূর প্রবাহিত হতে থাকে”। হযরত
সাদিক বলেন, “যতক্ষণ তুমি আমাকে ডাকেছিলে এবং আমার উপর ভরসা করছিলে, ততক্ষণ তুমি
অসত্যবাদী ছিলে; এখন যে জ্ঞান লাভ করলে, তা অতি যত্ন সহকারে মনে রেখ।”
অমর বানী
১। গুনাহ্ করার
সময় ভীত হওয়া এবং শেষে মাগফিরাত প্রাথনা করা একটি বিশেষ গুণ। এটা সুফীকে আল্লাহর
নৈকট্য লাভ করায় এবং যে ইবাদতের শুরুতে ভয় এবং শেষে ওযর ও অনুতাপ না থাকে, সে
ইবাদত সুফীকে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে রাখে।
২। অহংকারী
সুফীকে প্রকৃত সূফী বলা যায় না, কারণ সে গোনাহগার। আর যিনি মা’রিফাত কামনা করেন
তিনিই সূফী শ্রেণীভুক্ত।
৩ পাচঁ
ব্যক্তির সাথে সংস্রব রেখ না ঃ
(ক) মূখর্কে
সাথে রাখলে ঠকবে। সে তোমার হিতকামী হতে পারে, কিন্তু নিজ মূখর্তার দরুন তোমার
অমঙ্গল ঘটাবে।
(খ) কৃপণ- সে
সর্বদা নিজের লাভের জন্য তোমার ক্ষতি করবে।
(গ) নিদর্য়-
অভাবের সময় সে তোমাকে ধ্বংস করবে।
(ঘ) কাপুরুষ-
তোমার প্রয়োজনের সময় সে তোমাকে পরিত্যাগ
করবে।
(ঙ) ফাসিক- তার
লোভ-লালসা অত্যন্ত বেশী। নিজ স্বার্থের খাতিরে সে তোমাকে প্রাণে হত্যা করতেও
দ্ধিধাবোধ করবেনা।
৪। এই দুনিয়াত
জান্নাত ও জাহান্নামের নমুনা বুঝবার শক্তি আল্লাহ তা’আলা মানুষকে দিয়েছেন। শান্তি হল জান্নাত ও দুঃখ -কষ্ট
জাহান্নাম। সৎসঙ্গ লাভ করা হল বড় জিনিস। কিন্তু অনেক সময় কাফেরের সঙ্গেও অলী থাকেন
এবং নবীর সাথে ও কাফের ছিল । হযরত আছিয়া ছিলেন ফেরআউনের বিবি। অপরপক্ষে হযরত নূহ্
এবং হযরত লুত (আঃ)-এর বিবিগণ ছিল কাফের।
হযরত সহল
ইবনে আবদুল্লাহ্ তশতরী (রহঃ)
তরীকত পথের
পথিক হযরত সহল (রহঃ)
তশতর অঞ্চলের অধিবাসী
ছিলেন। তাঁর পিতার
নাম আবদুল্লাহ্। তিনি
হাকীকত-সমুদ্রে নিমজ্জিত, সাধককুল
বরেণ্য, লোক-চিত্তদর্শক ও
সত্য পথের দিশারী
ছিলেন। তিনি বিখ্যাত
ওলী ছিলেন। তিনি
সেই সময়ের সূফীতত্ত্বের
মোজতাহিদ ছিলেন। তিনি
তরীকত ও হাকিকতের
বাদশা ছিলেন। অনিদ্রায়
রাত কাটানো এবং
অনাহারে দিন যাপনে
অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন ছিলেন।
তিনি সে সময়ের
অদ্বিতীয় ইমাম। যিকির
ও কারামতে, সূক্ষ্ম
দর্শন ও গভীর
চিন্তায় সে সময়
তাঁর তুলনা ছিল
না। শরীয়তের আলেমরা
বলেন, “তিনি হাকীকত (তত্বজ্ঞান) ও
শরীয়ত (ধর্মজ্ঞান) উভয় বিদ্যায়
জ্ঞানী ছিলেন”। প্রকৃতপক্ষে
উভয়ই এক ; হাকীকত
শরীয়তের মূল রস
আর শরীয়ত হাকীকতের
মজ্জা সৃদশ। জুন্নুন
মিশরী (রহঃ) ছিলেন তাঁর
পীর। যে বছর
তিনি হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে
মক্কা শরীফের পথে
রওয়ানা দেন, সেখানেই
জুন্নুনের সাথে একত্রিত
হয়েছিলেন। তাঁর মতো
কোন অলী আল্লাহ্ও
এতো অল্প বয়সে
ধর্মের প্রতি এতো
অনুরাগী হননি। তাঁর
স্মরণ-শক্তি ছিল অত্যন্ত
প্রবল। তিনি বলেন,
“যখন আল্লাহ্ তাআলা
জিজ্ঞেস করেছিলেন, “অামি
কি তোমাদের প্রভূ
নই ?” আমি যে
বলেছিলাম, “হ্যাঁ”, তা
এখনও আমার স্মরণ
আছে। আমি মাতৃগর্ভে
থাকাকালীন ঘটনাসমূহও আমার
স্মরণ আছে।” তিনি
আরও বলেছেন, “যখন
আমার বয়স মাত্র
তিন বছর ছিল,
তখন আমি আমার
মামা মোহাম্মদ ইবনে
সাওয়ারের তাহাজ্জুদ নামায
পড়ার সময় তাঁর
পাশে দাড়িয়ে থাকতাম।
মামা বলতেন, “সহল,
তুমি শুয়ে থাক,
তুমি কাছে থাকলে
নামাযে আমার মন
চঞ্চল থাকে।” তবু
কিন্তু প্রকাশ্যে ও
গোপনে তাঁর কাযাবর্লী
দেখতাম”।
একদিন সহল
তাঁর মামাকে বললেন,
“মামা, আমি স্বপ্নে
দেখি যে, আমার
প্রাণ আরশের সামনে
নত হয়ে সিজ্দায়
রত”। তিনি জিজ্ঞেস
করলেন, “কখন থেকে
তোমার এ অবস্থা ?”
সহল বললেন, “সব
সময়ই এরূপ হয়”।
তারপর তাঁর মামা
বললেন, “বৎস, তোমার
এ অবস্থা কারও
কাছে প্রকাশ কর
না এই কালামটুকু
স্মরণ রেখো এবং
প্রতি রাত্রে পড়ো- “আল্লাহ্ আমার
সাথে আছেন, আল্লাহ্
আমার প্রতি দৃষ্টিকারী,
আল্লাহ্ আমার সাক্ষীস্বরূপ”। সেই
থেকেই আমি এই
পাক কালাম পাঠ
করতাম। তারপর মামাকে
তা জানালে, তিনি এ পাক
কালাম প্রতি রাত্রে
মাত্র সাতবার পড়তে
হুকুম দিলেন। আমি
সে মতে আমল
করলাম। কিছুদিন পর
তাঁকে সংবাদ জানালে,
তিনি এ পাক
কালাম প্রতি রাত্রে
পনের বার পড়তে
হুকুম দিলেন। এতে
আমার অন্তরে এক
অপূর্ব স্বাদ অনুভব
করতে ছিলাম। প্রায়
এক বছর এভাবে
অতিবাহিত হলে পর
মামা বললেন, “আমি
তোমাকে যা শিক্ষা
দিয়েছি, তা স্মরণ
রেখ। সবসময় সে
মতে আমল করলে
আখিরাতে এর সুফল
পাবে”।
তারপর মামা
বলেন, “হে সহল !
যে ব্যক্তি আল্লাহ্
তাআলাকে দর্শন করেন
এবং তাঁর সাথে
ভাব করেন, তিনি
আবার কিভাবে পাপ
কাজ করতে পারে ? তুমি
কখনও পাপ কর না
!” এরপর
থেকে আমি নির্জনতায়
বাস করতে লাগলাম।
তার কিছুদিন পর
মামা আমাকে মক্তবে
পাঠিয়ে দিলেন। আমি
মামাকে বললাম, “আমার
ভয় হয়, পাছে
আমার সাহস ও
মন ঠিক না
থাকে। আপনি ওস্তাদজীর
সাথে এই শর্ত
করুন যে, আমি
অল্পক্ষণ মক্তবে থেকেই
আপন কাজে চলে
যাব।” সে মতেই
কাজ করা হলো।
আমি সাত বছর
বয়সে কোরআন শরীফ
পাঠ শেষ করি।
এবং তখন থেকেই
নিয়মিত রোজা রাখি।
আর যবের রুটি
ছিল আমার একমাত্র
খাদ্য। বার বছর
বয়সে আমার মনে
একটি কঠিন মাস্আলার (প্রশ্ন) উদয়
হয়, যার মীমাংসা
কেউই করতে সক্ষম
হল না। অগত্যা
আমি মামার অনুমতি
নিয়ে বসরা নগরে
গমণ করি। সেখানকার
ওলামাগণও এর সন্তোষজনক
জওয়াব দিতে সক্ষম
হননি। তারপর আমি
সেখানকার বিখ্যাত আবেদ
হাবীব-হামজার শরণাপন্ন হই।
অবশেষে তাঁর কাছে
সন্তোষজন জওয়াব পেয়ে
অত্যন্ত সন্তুষ্ঠ হই।
তৎপর কিছুকাল তাঁর
পাক সান্নিধ্যে থেকে
আমার খাদ্য এরূপ
নির্দিষ্ঠ করে নিলাম
যে, সারা বছরের
জন্য এক দির্হাম
মূল্যের যব ক্রয়
করে চূর্ণ করত
রুটি প্রস্তুত করে
প্রতি রাত্রে এক
ঊকিয়া (২ তোলা) পরিমাণ রুটি তরকারী (ব্যঞ্জন) সহ আহার
করতাম।
পরে তিন
দিন পরপর রোজার
ইফতার করতে মনস্থ
করি। তারপর পাঁচ
দিন পরপর, এর
কিছুদিন পর সাত
দিন পরপর ইফ্তার
করতে অভ্যস্থ হই।
পরে কখনও এরূপ
অবস্থা হয় যে,
৪০ দিন-রাত্রের মধ্যে
কেবলমাত্র একটি বাদামের
শাঁস আহার করে
কাটিয়েছি। তিনি বলেন,
“আমি কয়েক বছর
ক্ষুধার্ত থেকে এবং
তৃপ্তি সহকারে খাবার
গ্রহন করে সকল
ভাবেই নিজেকে পরীক্ষা
করেছি। প্রথমতঃ কিছুদিন
ক্ষুধায় দুর্বলতা ও
আহারে সুস্থতা বোধ
করেছিলাম। কিন্তু কিছুদিন
পর দেখি, আহারে
দুর্বলতা আসে আর
অনাহারে শক্তি পাই।
তারপর আমি আল্লাহ্
তাআলার দরবারে মোনাজাত
করি, “হে আল্লাহ্
আমার বোধশক্তিকে উভয়
দিক্ (ক্ষুধা ও তৃপ্তি)
থেকে বন্ধ করে
দাও, যেন আমি
ক্ষুধায় তৃপ্ত ও
ভোজনে ক্ষুধার্ত হই।”
তিনি প্রায় পূর্ণ
শা’বান মাসই রোযা
রাখতেন। আর রমজান
মাসে তিনি রাত্রে
একবার মাত্র কিছু
খাদ্য গ্রহন করতেন
এবং দিবারাত্রি ইবাদতেই
কাটিয়ে দিতেন।
একবার সহল
বলেন, “নেক্কার বা বদ্কার প্রত্যেকের
জন্যই তওবা করা
ফরজ”। তশ্তরে একজন
বিখ্যাত আলেম তাঁর এ কথার
প্রতিবাদ করে বলেন
যে, “তবে পাপীকে
তা পাপ থেকে
ও নেক্কারকে তার
ইবাদত থেকে তওবা
করতে হবে !” তাঁর
কঠোর সমালোচনা করতে
করতে তাঁকে জনসমাজে
কিছু হেয় করলেন,
তাঁর কাযাবর্লীকে শরীয়তের
খেলাফ আখ্যা দিয়ে
তাঁর প্রতি কুফরীর
ফতোয়া দিলেন এবং ছোট-বড় সকলকে
তাঁর বিরুদ্ধে উত্তেজিত
করে তুললেন। কিন্তু
সহল সে দিকে
ভ্রূক্ষেপও করলেন না।
কোনরূপ মোনাযেরা বা
তর্কেও যেতে চাইলেন
না। অবশেষে প্রকৃত
আল্লাহ্ প্রেমিকরা তাঁর
বাক্যই সমর্থন করলেন।
এর কিছুদিন
পর তাঁর অন্তরে
আল্লাহ্ প্রেমের যে
কি ঢেউ খেলে
গেলো ; একদিন জমি-জমা,
বাড়ি-ঘর, সোনা-রূপা ও
স্থাবর-অস্থাবর যত সম্পত্তি
ছিল, তাদের প্রত্যেকটি
বস্তুর নাম পৃথক
পৃথক কাগজে লিখলেন,
এবং বহু লোককে
ডেকে একত্র করলেন।
পরে এ কাগজের
টুকরাগুলো তাদের দিকে
ছুঁড়ে দিয়ে বললেন,
“প্রত্যেকে একটি করে
কাগজখন্ড কুড়িয়ে নাও।”
অতএব যে যেই
কাগজ পেল, তাকে
তিনি সেই কাগজে
লিখা বস্তু দিয়ে
দিলেন। এভাবে সমস্ত
ধন-সম্পত্তি জনসাধারণকে বিলিয়ে
আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায়
করে মক্কা শরীফ
রওনা হলেন। তিনি
নিজের মনকে বললেন,
“হে মন, তুমি
ত জান, এখন
আমি দরিদ্র ও
সর্বহারা। অতএব আমার
কাছে আর কিছু
অভিলাষ করো না।”
নফ্সও ওয়াদা করল
যে, সে আর
কিছুই চাইবে না।
চলতে চলতে সহল
কুফা শহরে পৌঁছলে
নফ্স বলল, “আমি
এখন পযর্ন্ত আপনার
কাছে কিছুই চাই
নি, কিন্তু এখন
আমাকে কিছু রুটি
ও মাছ খেতে
দিন ; তাহলে মক্কা
পযর্ন্ত আপনার কাছে
আর কিছুই চাইব
না।”
শহরে প্রবেশ
করে সহল একস্থানে
দেখতে পান, একটি
আটা পিষার যাঁতাকল।
একটি উট তাকে
টানছে। তিনি মালিককে
ডেকে বললেন, “এই
উটের দৈনিক মজুরী
কত ?” লোকটি বলল,
“দুই দিরহাম”। তিনি
বললেন, “এই উটটিকে
খুলে আমাকে তদস্থলে
জুড়ে দাও। আমি
সন্ধ্যা পযর্ন্ত তোমার
এ যাঁতা চালাব।
এর বদলে তুমি
আমাকে মাত্র এক
দিরহাম মজুরী দিবে।”
যাঁতার মালিক উটকে
খুলে দিয়ে সহলকেই
সে কাজে নিয়োগ
করল এবং সন্ধ্যার
সময় তাঁকে এক
দিরহাম মজুরী দিয়ে
দিল। তিনি মজুরীর
এই এক দিরহাম
মূল্যের রুটি ও
মাছ কিনে সম্মুখে
নিয়ে খেতে বসে
বললেন, “হে নফ্স,
আবার কখনও কিছু
ইচ্ছা করবি পূর্বে
এ-কথাও ভেবেনিও যে,
সকাল হতে সন্ধ্যা
পযর্ন্ত পশুর খাটুনি
খাটলে তবে ইচ্ছা
পূর্ণ হবে”।
অতঃপর সহল (রহঃ)
মক্কা শরীফ যাওয়ার
উদ্দেশ্যে রওনা করেন
এবং সেখানে বহু
মহাত্মার সাথে সাক্ষাত
করেন। কিছুদিন পর তশ্তরে ফিরে
আসেন এবং পথিমধ্যে
যন্নুন মিশ্রী (রহঃ)-এর
হাতে বায়আত হন।
কথিত আছে, তারপর
থেকে তিনি কখনও
দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে
এবং লম্বাভাবে পা
ছড়িয়ে বসতেন না,
মিম্বরে আরোহণ করতেন
না। একবার চারমাস
পযর্ন্ত তিনি পায়ের
আঙ্গুল বেঁধে রেখেছিলেন।
জনৈক দরবেশ জিজ্ঞেস
করল, “পায়ের আঙ্গুলে
কি হয়েছে ?” তিনি
বললেন, “কিছুই না”।
ঘটনাক্রমে সে দরবেশ
যুন্নুন মিশরীর কাছে
মিশরে গমন করেন
এবং তাঁকেও পায়ের
আঙ্গুল বন্ধন অবস্থায়
দেখতে পেয়ে কারণ
জিজ্ঞেস করলেন। তিনি
উত্তরে বললেন, “আঙ্গুলে
কিছু ব্যথা আছে”।
জিজ্ঞেস করলেন, “কখন
হতে ?” যন্নুন বললেন,
“চারমাস যাবত”। তারপর
সে দরবেশ হিসাব
করে দেখলেন যে,
“যেই তারিখ হতে
সহল পায়ের আঙ্গুল
বেঁধে ছিলেন, এটাও
সে তারিখ থেকেই
ছিল”। হযরত যুন্নুনের
প্রতি সমবেদনা ও
সম্মান দেখানই ছিল
সহলের পায়ের আঙ্গুল
বেঁধে রাখার একমাত্র
কারণ। কেননা যুন্নুন
ছিলেন সহলের ওস্তাদ
এবং মোরশিদ।
এই ঘটনা
বর্ণনাকারী দরবেশ বলেন,
“তারপর আমি হযরত
যুন্নুনকে হযরত সহলের
ঘটনা বর্ণনা করি।
যুন্নুন সবকিছু অবগত
হয়ে বললেন, “সহল
ব্যতীত আমার মুরীদদের
মধ্যে এমন কে
আছে যে, আমার
ব্যথার কথা জেনে
আমাকে সমবেদনা জানাবে ?’’
কথিত আছে, একদিন
সহল তশ্তরী পা
লম্বা করে ছড়িয়ে
এবং দেয়ালে পিঠ
রেখে বসে বললেন,
“তোমাদের যা ইচ্ছা
হয়, এখন আমাকে
জিজ্ঞেস করতে পারো।”
লোকে বলল, ‘‘হুজুর,
আপনি ত ইতিপূর্বে
কখনও এরূপ করেন
নি ?” তিনি উত্তরে
বললেন, “যতদিন ওস্তাদ
জীবিত থাকেন, শাগরেদকে
ততদিন আদবের সাথে
থাকা কর্তব্য।” পরে
জানা গেল, এই
তারিখেই হযরত যুন্নুন
মিশরী (রহঃ) ওফাত প্রাপ্ত
হয়েছিলেন।
একদিন বাদশাহ্
আমর-লাইস গুরুতর রোগে
আক্রান্ত হলেন। চিকিৎসকরা
সে রোগের চিকিৎসায়
অসমর্থ হয়ে গেলে
বাদশা বললেন, “এখন
এই রোগের জন্য
দোয়ার প্রয়োজন”। লোকে
বলল, “হযরত সহল
তশ্তরীর দোয়াই কবুল
হওয়ার আশা রাখা
যায়।” সুতরাং তাকে
দরবারে আনা হলো।
তিনি বাদশার কাছে
বসে বললেন, “সেই
ব্যক্তির ক্ষেত্রে দোয়া
কবুল হয়, যে
নিজ গোনাহের জন্য
তওবা করে আল্লাহ্
পাকের দিকে প্রত্যাবর্তন
করে। জেলখানায় বহু
মজলুম ব্যক্তি রয়েছে,
প্রথমে তাদেরকে মুক্তি
দিতে হবে। সেই
সাথে আপনাকে তওবা
করতে হবে।” সহলের
নির্দেশ মতো বাদশা
তাই করেলেন। তারপর
সহল মোনাজাত করলেন,
“হে রাহমানুর রাহীম !
তার নাফরমানীর দুর্গতি
তাকে দেখিয়েছ, এখন
আমার ফরমাবরদারীর ইয্যত
তাকে দেখাও। তার
অন্তরকে যেমন তুমি
তওবার পোষাক পড়িয়েছ,
তেমনি তার শরীরকে
আরোগ্যের পোষাক পড়াও।”
এই দোয়ার পরক্ষণেই
আমর-লাইস আরোগ্য লাভ
করেন। আরোগ্য লাভের
পর তিনি সহলের
উদ্দেশ্যে হাদিয়া স্বরূপ
বহু ধন-দৌলত নিয়ে
উপস্থিত হলেন। তিনি
কিছুই গ্রহন করলেন
না এবং সেখান
থেকে চলে গেলেন।
পথে একজন মুরীদ
বলেন, “হুজুর, যদি
আপনি কিছু ধন-সম্পত্তি
গ্রহন করতেন, তাহলে
তা দ্বারা আমার
ঋণটুকু শোধ হয়ে
যেতো এবং খুবই
ভালো হতো।” সহল
মুরীদকে বলেন, “তোমার
ধন-সম্পত্তি প্রয়োজন ? আচ্ছা,
সামনে তাকিয়ে দেখ।”
মুরীদ তাকিয়ে দেখে
যে, সারা মাঠ
সোনা ও মনি-মুক্তায়
ভরে রয়েছে। তারপর
সহল বলেন, “আল্লাহ্
তাআলা যাকে এত
ধন-সম্পদ দান করেছেন,
বল ত সে
মানুষের দেওয়া তুচ্ছ
ধন-সম্পদের কেন প্রত্যাশা
করবে ?”
সহল আল্লাহ্
পাকের প্রশংসা শুনলে
ভাবে বিভোর হয়ে
পড়তেন এবং কখনও
কয়েকদিন যাবত আহারাদি
ত্যাগ করে এই
অবস্থায় থাকতেন। শীতকালেও
তাঁর শরীর হতে
ঘাম বের হয়ে
জামা ভিজে যেতো
এবং ফোঁটা ফোঁটা
করে ঘাম ঝরে
পড়ত। এই অবস্থায়
আলেমগণ কোন প্রশ্ন
করলে করলে, তিনি
জওয়াবে বলতেন, “এই
অবস্থায় আমার কথায়
তোমাদের কোন উপকার
হবে না।” একদিন
সহল মসজিদে বসে
আছেন, গরমের দিন
ছিল সেটা, একটি
কবুতর উড়তে উড়তে
ক্লান্ত হয়ে মসজিদের
উঠানে পড়ে গেলো।
তৎক্ষণাৎ তিনি বলে
উঠলেন, “কেরমানের বাদশাহ
ইন্তেকাল করেছেন।” পরে
খোঁজ নিয়ে জানা
গেল, ঠিক সেই
মুহূর্তেই বাদশাহ ইন্তিকাল
করেছিলেন। বর্ণিত আছে
যে, বাঘ ও
অন্যান্য হিংস্র জন্তু
তাঁর নিকট আসত।
তিনি তাদের আদর
করতেন ও খাবার
দিতেন। এজন্য আজ
পযর্ন্ত তাঁর ঘরকে
বায়তুস্ সেবা বা
হিংস্রজন্তুর আবাস বলা
হয়।
সহল তাঁর
কোন মুরীদকে বলেন,
“সারাদিন আল্লাহ্ আল্লাহ্
বলতে চেষ্টা করবে।”
মুরীদ তাই করল
এবং ক্রমে তা
তার অভ্যাসে পরিণত
হয়ে গেল। তৎপর
হুকুম করলেন, “সারা
রাতও আল্লাহ্ আল্লাহ্
করতে থাকবে।” সে
তাই করল। অবশেষে
তার অবস্থা এমন
হলো যে, ঘুমের
মধ্যেও সে আল্লাহ্
আল্লাহ্ বলছে। তারপর
সহল মুরীদকে বললেন,
“তুমি এখন মুখে
আল্লাহ্ আল্লাহ্ বলা
বন্ধ কর এবং
মনে মনে আল্লাহ্র
নাম যিক্র কর”।
সে ব্যক্তি তাই
করল এবং এই
নীরব যিকিরেই নিজকে
দিবারাত্র নিম্গ্ন রাখল।
একবার সেই মুরীদ
ঘরে যিকিরে মশগুল
হয়ে বসে আছেন,
ঘটনাক্রমে ছাদের একটি
কাঠ তার মাথায়
পড়ে যায় এবং
মাথা থেকে রক্ত
ঝরতে থাকে। তখন
রক্তের ফোঁটাগুলো মাটিতে
পড়ে আরবীতে “আল্লাহ্”
শব্দের আকার ধারণ
করছিল।
কথিত আছে
যে, একবার সহল
একজন মুরীদকে বললেন,
“বস্রা নগরে একজন
রুটি বিক্রেতা আছেন,
যিনি বেলায়েতের (দরবেশীর) মযার্দা
লাভ করেছেন। সেই
মুরীদ তাঁর সাথে
সাক্ষাৎ করার জন্য
বস্রা যাত্রা করলেন।
বস্রায় পৌঁছে তিনি
দেখেন যে, অন্যান্য
রুটি বিক্রেতার মতো
সেও (দাড়িকে আগুনের
হাত থেকে রক্ষা
করার জ্ন্য) দাড়িকে
উর্ধ্বমুখী করে মুখে
পট্টি বেঁধে রেখেছে।
এই অবস্থা দেখে
তাঁর ওপর সেই
মুরীদের অভক্তি এলো
এবং মনে মনে
ধারণা জন্মালো যে,
এই দরবেশ যদি
সত্যিই কামালিয়াতের দরজায়
পৌঁছে থাকতেন, তবে
আগুনের ভয়ে এমন
করতেন না। তবুও
তিনি কাছে গিয়ে
দরবেশকে সালাম জানালেন
ও কিছু প্রশ্ন
করলেন। দরবেশ বললেন,
“তুমি যখন প্রথমেই
আমাকে হেলার চোখে
দেখেছ তখন আমার
কথায় আর তোমার
কোন উপকার হবে
না।”
সহল বলেছেন,
“একদিন আমি একাকী
মাঠের পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন
সময় এক বৃদ্ধাকে
দেখলাম, মাথায় কাপড়
জড়ানো এবং লাঠি
ভর দিয়ে চলছে।
আমি ভাবলাম, হয়ত
এই বৃদ্ধা কাফেলা
হতে দূরে সরে
পড়েছে। আমি বেচারীকে
কিছু সাহায্য করার
জন্য জামার পকেটে
হাত দিলাম। সে
লজ্জা ও বিস্ময়ভরে
দাঁতে আঙ্গুল কেটে
উর্ধ্বে শূণ্যপানে হাত
বাড়াল। দেখতে দেখতে
তাঁর হাত স্বর্ণ
মুদ্রায় ভরে গেলো।
বৃদ্ধা তখন আমাকে
বললেন, “সহল, তুমি
পকেট থেকে হাত
বের কর, আর
আমি শূণ্য থেকেই
পেয়ে থাকি।” এটা
বলেই সে অদৃশ্য
হয়ে গেলো। আমি
অবাক হয়ে চলতে
লাগলাম। ক্রমে আরাফাতের
ময়দানে উপস্থিত হলাম।
যখন আমি তাওয়াফের
স্থানে পৌঁছলাম, তখন
কা’বা ঘরকে এক
ব্যক্তির চারদিকে তওয়াফ
করতে দেখে বিস্ময়ে
হতবাক হয়ে তাঁর
কাছে গেলাম। কাছে
এসে দেখি, সেই
বৃদ্ধা। সে আমাকে র্খে
বলল, “সহল, যে
ব্যক্তি কা’বার সৌন্দরয্য
দেখতে এখানে আসে,
কা’বার তওয়াফ করাই
তার উচিত। কিন্তু
যে আত্মচেতনাসহ পরম
করুণাময়ের সৌন্দরয্য দেখতে
আসে, এমনজনের তওয়াফ
করা কা’বা ঘরের
জন্য মানায়”।
সহল বলেছেন,
“জনৈক আব্দাল (কামেল দরবেশ)
আমার কাছে আসতেন।
আমি তাঁর সাথে
সংস্রব রাখতাম এবং
রাতের বেলা তাঁর
কাছে মা’রিফাত সম্পর্কিত
অনেক মাসআলা জিজ্ঞেস
করে জেনে নিতাম।
কারণ দিনের বেলা
তাঁকে খুঁজে পাওয়া
যেতো না। তিনি
ভোরে ফজরের নামায
পড়ে পানির ভিতরে
গিয়ে বসতেন এবং
দুপুরের আযান পযর্ন্ত
সেখানেই আত্মগোপন করে
থাকতেন। মুয়াজ্জিন যোহরের
আযান দিলে তিনি
পানি হতে উঠে
আসতেন এবং জামাতের
সাথে নামায পড়ে
আবার পানিতে চলে
যেতেন। অথচ তাঁর
শরীরের একটি পশমও
ভিজতো না। মাগরিব
পযর্ন্ত প্রত্যেক নামাযের
সময় তিনি এমন
করতেন। সহল বলেন,
“বহুদিন পযর্ন্ত এই
দরবেশ এভাবে আমার
সাথে ছিলেন। কিন্তু
আশ্চরযের বিষয়, এই
দীর্ঘদিনের মধ্যে কোনদিন
তাঁকে কারও কাছে
বসতে কিংবা কিছু
খাবার খেতে দেখি
নাই। অবশেষে একদিন
তিনি চলে গেলেন”।
সহল বলেন,
“আমি এক রাত্রে
কেয়ামত স্বপ্নে দেখলাম।
সমস্ত লোক হাশরের
মাঠে দাঁড়িয়ে আছে।
একটি সাদা রঙের
পাখি দেখলাম হঠাৎ
নীচে নেমে এক এক জনকে
ধরে জান্নাতের দিকে
নিয়ে যাচ্ছে। আমি
জিজ্ঞেস করলাম, “এ
কোন্ পাখি ?” কেউ
একজন বলল, “এটা
আল্লাহ্ পাক নিজ
বান্দার ওপর সাদা
পাখিরূপে রহমতস্বরূপ নাযেল
করেছেন। এমনি সময়
হঠাৎ এক টুকরা
কাগজ শূণ্য হতে
মাটিতে পড়ল। আমি
তা খুলে পড়লাম।
তাতে লেখা ছিল,
“এই পাখির নাম
‘তরকে-দুনিয়া (অর্থাৎ সংসার
বিমুখতা)।” আর একদিন
স্বপ্নে দেখলাম যে,
আমাকে জান্নাতে নেওয়া
হয়েছে। সেখানে তিনশত
লোক উপস্থিত দেখলাম
এবং সবাইকে সালাম
করে জিজ্ঞেস করলাম
যে, “সংসারে আপনাদের
কাছে সবচেয়ে ভয়ের
বিষয় কি ছিল ?”
সবাই একবাক্যে বললেন,
“কেবল শেষ নিঃশ্বাসের
অর্থাৎ ঈমানের সাথে
মৃত্যুর ভয়”।
তিনি বলেছেন,
“আমি একবার ইবলীসকে
স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞেস
করলাম, তোমার পক্ষে
সবচেয়ে দূরবোধ্য বিষয়
কোনটি ? সে বলল,
আল্লাহ্ তা’আলার সাথে
তাঁর বান্দার অন্তঃকরণের
ইঙ্গিত।” সহল বলেন,
“আমি একবার ইবলীসকে
একদল লোকের মধ্যে
দেখতে পাই এবং
বড় সাহসের সাথে
তাকে আবদ্ধ করে
ফেলি। পরে সেই
দল চলে গেলে
আমি ইবলীসকে বললাম,
“যে পযর্ন্ত আল্লাহ্
তা’আলার একত্ববাদ সম্পর্কে
কিছু বর্ণনা না
করবে সে পযর্ন্ত
তোমাকে ছাড়ব না।”
ইবলীস সে সম্পর্কে
এমন বক্তৃতা দিলো
যে, সেখানে কোন
আরেফ ব্যক্তি উপস্থিত
থাকলেও বিস্ময়ে হতবাক
হয়ে যেতেন।”
তিনি বলেছেন,
“আমি এক রাতে
এক ব্যক্তিকে ক্ষুধার্ত
দেখে তাঁর সামনে
খাবার হাজির করলাম।
কিন্তু সে খাবার
কিছু সন্দেহজনক ছিল।
তিনি তা আহার
করলেন না। এভাবে
সারারাত তিনি উপবাসে
কাটালেন। ক্ষুধার জ্বালায়
ইবাদতও করতে পারলেন
না। সহল বলেন,
এই ব্যক্তি তিন
বছর যাবত অবিরত
ইবাদতে মশগুল ছিলেন,
শুধু অদ্য রাত্রিই
তাঁর বৃথা গেল।
কিন্তু এ এক
রাত উপবাস থাকা
ও সন্দেহজনক খাদ্য
আহার না করার
পুরষ্কার তিনি মহান
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের
দরবারে এত অধিক
পেয়েছিলেন যে, সারা
দুনিয়ার নেক্ কাজের
সওয়াবও ইহার তুলনায়
কম।” সহল বলেছেন,
“খাবার দিয়ে উদর
পূর্ণ করা, চাই
তা হালালই হোক
না কেন, তার
চাইতে শরাব দিয়ে
উদর পূর্ণ করাকে
বরং আমি শ্রেয়
মনে করি।” প্রশ্ন
করা হলো, “কেন ?”
তিনি বললেন, “যেহেতু
শরাব দিয়ে উদর
পূর্ণ করলে জ্ঞান
লোপ পায়, মোহ
এবং কামের আগুন
নিস্তেজ হয়, হাত
ও জিহ্বার ক্ষতিসাধন
হতে লোক নিরাপদ
থাকে। কিন্তু হালাল
খাদ্যও উদর পূর্ণ
করে খেলে কুপ্রবৃত্তি
ও ষড় রিপুসমূহ
মাথা চাড়া দিয়ে
উঠে এবং অকাজ-কুকাজের
বাসনা প্রবল হয়।
নফ্স নিজ খায়েশ
পূর্ণ করার আশায়
গোয়াতুর্মী শুরু করে।”
হযরত সহল (রহঃ)-এর
মুনাজাত ঃ-“ইলাহী, তুমি আমাকে
স্মরণ করেছ, বস্তুতঃ
আমি তেমন কোন
বস্তুই নই। যদি
আমি তোমাকে বারবার
স্মরণ করি, তবে
তার কিছুই আমার
পক্ষে এই সন্তুষ্টি
যথেষ্ট নয়। বস্তুত
আমা হতে অধম
কেউই নেই।” বলা
হয়, সহল (রহঃ) বড় আলেম ও ওয়ায়েজ
ছিলেন। তাঁর নসীহতে
বহুলোক সৎপথ গ্রহন
করেছে। যেইদিন তিনি এই দুনিয়া
ছেড়ে যান, তাঁর
চারশত মুরীদ তাঁর
শিয়রেই বসা ছিলেন।
তারা বললেন, “হুজুর,
আপনার ইন্তেকালের পর
কে আপনার স্থলে
বসবে ?” এবং কে
আপনার মিম্বরে দাঁড়িয়ে
নসীহত করবে ?” তিনি
চোখ খুলে বললেন,
“আমার স্থলে শাদেদেল (জনৈক
অগ্নিপূজক) বসবে।” মুরীদরা
ভাবলেন পীরসাহেব সম্ভবতঃ
মৃত্যু যন্ত্রণায় বেহুঁশ
হয়ে এসব আবোল-তাবোল
বলছেন। কেননা তাঁর
চারশত বিজ্ঞ আলেম
মুরীদ থাকা সত্ত্বেও
তিনি কিভাবে একজন
কাফেরকে তাঁর স্থানে
বসাতে পারেন ? তিনি
পুনঃ ধীরস্থিরভাবে বললেন,
“গণ্ডগোল করো না।
যাও, শাদে-দেল্কে ডেকে
আন।” তারা তাড়াতাড়ি
সেই কাফেরকে ডেকে
আনল। সহল শাদে-দেল্কে
দেখে বললেন, “আমার
ইন্তেকালের তিন দিন
পর যোহরের নামাজ
শেষে আমার এই
মিম্বরে বসে সকলকে
নসীহত করবে।” এতটুকু
বলেই তিনি এই
দুনিয়া ছেড়ে চলে
গেলেন।
তৃতীয় দিন
জোহরের নামাজ শেষে
বহু লোক সেখানে
হাজির হলো, শাদে-দেল্ও
সেখানে হাজির হলো
এবং কাফেরী টুপি
মাথায় দিয়েই মিম্বরের
উপর এসে বসল।
এই পযর্ন্ত কাফেরী
পৈতাও তার শরীর
হতে খোলা হয়
নি। শাদেদেল্ মিম্বরে
বসে সকলকে ডেকে
বলল, “হে বন্ধুগণ,
তোমাদের পীর ও
গুরুজী আমাকে তোমাদের
পথের দিশারী নিযুক্ত
করে গেছেন এবং
বলে গেছেন, “হে
শাদে-দেল্ ! শীঘ্রই তোমার
এমন সময় আসবে,
যে তুমি কুফ্রীর
পৈতা কেটে ফেলবে।” একথা
বলেই শাদে দেল্
নিজ পৈতা কেটে
ফেললেন, কাফেরী টুপী
মাথা থেকে খুলে
দূরে নিক্ষেপ করলেন
এবং (আশহাদু আল্লাইলাহা
ইল্লাল্লাহ ওয়া আশহাদুআন্না
মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্) বলে
ইসলাম গ্রহন করলেন।
তৎপর বললেন, “শেখ
সহল (রহঃ) তোমাদেরকে নসীহত
করতেও আমাকে হুকুম
করেছেন। তোমাদের মুরশীদের
নসীহত মান্য করা
তোমাদের ফরজ। কাজেই
শুন ! “শাদে দেল্
কাফেরীর পৈতা কেটে
ফেলেছে। তোমরা যদি
কেয়ামতের মাঠে আমাদের
পুনর্মিলনের আশা কর,
তবে তোমাদের বাতেনী
কুফ্রীর পৈতা কেটে
ফেল !” একথা শুনে
শ্রোতারা কাঁদতে কাঁদতে
বেঁহুশ হয়ে পড়ল।
বর্ণিত আছে,
সহলের জানাযা বহন
করে নিয়ে যাওয়ার
সময় বহু লোক
একত্র হয়েছিল। লোকের
হা-হুতাশ ও বিলাপ
শুনে একজন ৭০
বছর বয়ষ্ক ইহুদী
ঘর হতে বের
হয়ে পড়ল। জানাযা
তার কাছে উপস্থিত
হলে সে চীৎকার
করে বলতে লাগল,
“হে মানব ! আমি
যা দেখছি, তোমরাও
কি তা দেখছ ?”
লোকগণ জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কি দেখছ ?”
সে বলল, “আমি
দেখছি যে, আকাশ
হতে ফেরেশতাগণ নেমে
আসছে এবং জানাজায়
শরীক হচ্ছে।” সেই
সময়েই সে কালেমা
শাহাদাত পড়ে মুসলমান
হয়ে যায়। আবু
তালহা বলেন ঃ যে দিন
সহল দুনিয়ায় আসেন,
সে দিন তিনি
রোযাদার ছিলেন এবং
যে দিন এই
দুনিয়া ত্যাগ করেন,
সে দিনও তিনি
রোজাদার ছিলেন।
বর্ণিত আছে, একদিন
সহল নিজ মুরীদসহ
বসে আছেন, এমন
সময় এক ব্যক্তি
সেখানে উপস্থিত হল। সহল বললেন,
“এই ব্যক্তির কাছে
কিছু মা’রিফাত আছে”।
লোকেরা তাঁর কাছে
যাওয়া মাত্রই সে
গায়েব হয়ে গেল।
সহলের ওফাতের পর
সেই ব্যক্তি একদিন
তাঁর কবরের কাছে
দিয়ে যাচ্ছিল। একজন
মুরীদ লোকটিকে চিনতে
পেরে কবরের প্রতি
ইঙ্গিত করে বলল, “ওহে
শেখ, যাঁকে এখানে
দাফন করা হয়েছে,
তিনি একদিন বলেছিলেন
যে, আপনি কিছু
মা’রিফাতের অধিকারী। যে
আল্লাহ্ আপনাকে এই
মা’রিফাতের অধিকারী করেছেন
তাঁর কসম ! মেহেরবানী
করে আমাদেরকে কিছু
কারামত প্রদর্শন করুন।”
এ কথা শুনে
লোকটি কবরের প্রতি
ইঙ্গিত করে বললেন,
“হে সহল ! কথা
বলুন ! কবর থেকে
সহল উচ্চশব্দে বলে
উঠলেন, “(লা ইলাহা
ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা
শারিকালাহু) অাল্লাহ্ ছাড়া
কোন প্রভু নাই
এবং তাঁর কোন
শরীক নাই।” পুণরায়
জিজ্ঞাসা করা হলো,
“হে সহল ! এ
যে বলা হয়,
“যিনি এই কালেমা
পাঠ করেন, তাঁর
কবর কখনও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়
না- একথা কি
সত্য ?” কবর থেকে
পুণরায় উত্তর এলো,
“হ্যাঁ, সত্য”।
হযরত ফতেহ্
মুসেলী (রহঃ)
হযরত ফতেহ্
মুসেলী (রহঃ) সবর্শাস্ত্রে সুপন্ডিত
ও সবর্জন প্রশংসিত
ব্যক্তি ছিলেন। তিনি
আল্লাহ্ প্রেমে মশগুলদের
মধ্যে অন্যতম পুরুষ
ছিলেন। ইরান দেশের
অর্ন্তগত মুসেল নগরে
তাঁর জন্ম। তিনি
অতিশয় সৎসাহসী, কঠোর
সাধক ও উচ্চাসনে
আসীন এবং আল্লাহ্র
ভয়ে ভীত ও
আল্লাহ্ ভক্ত ও
অলীরূপে সবর্ত্র পরিচিত
ছিলেন। তিনি মানুষের
সংস্পর্শ হতে দূরে
সবর্দা আত্মগোপন করে
থাকতেন। বণিকদের ন্যায়
এক গোছা চাবি
সবসময় তিনি সাথে
রাখতেন। যেখানে যেতেন,
জায়নামাজের উপর চাবির
গোছাটি রেখে নামায
পড়তেন, যেন কেহ
তাঁকে দরবেশ বলে
চিনতে না পারে।
একদিন একজন দরবেশ
তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনি এ-সকল চাবি
দিয়ে কি খোলেন ?”
তিনি এর কোন
উত্তর দিলেন না।
একজন বুযুর্গ লোককে
জিজ্ঞেস করা হল,
“ফতেহ্ মুসেলীর কি
কোন ইলেম আছে ?”
তিনি উত্তরে বললেন,
“তিনি যে সংসার
ত্যাগ করেছেন, এ
ইলেমই (জ্ঞান) তাঁর জন্য
যথেষ্ট।”
আবু আবদুল্লাহ্
বলেন, “একদা আমি
সর্রী সকতীর ঘরে
ছিলাম। রাতের কিছু
অংশ কেটে গেলে
সর্রী ভাল কাপড়
পরিধান করে একটি
চাদর কাধেঁ নিয়ে
রওয়ানা হলেন। আমি
জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায়
যাচ্ছেন ?” তিনি বললেন,
“ফতেহ্ মুসেলীর দর্শন
করতে যাচ্ছি।” বাইরে
এলে চৌকিদার তাঁকে
ধরে অন্যকিছু ভেবে
জেলে বন্দি করে
রাখল। পরদিন সকালে
জেল-দারোগা সকল কয়েদিদেরকে
প্রহার করার হুকুম
দিলে জল্লাদ একে
একে সকলকে প্রহার
করতে লাগল। যখন
সর্রীর পালা এলো,
তাঁকে প্রহার করবার
জন্য সে হাত
উঠালে, তার হাত
শূণ্যে রয়ে যায়,
আর তা নাড়াতে
পারে না। দারোগা
রাগ করে বলল,
“কেন তাকে প্রহার
করছ না ?” জল্লাদ
বলল, “একজন বৃদ্ধ
ব্যক্তি আমার হাত
ধরে রেখেছে এবং
বলছে, “সাবধান ! তাঁকে
মের না,” এজন্য
আমি হাত নাড়তে
অক্ষম।” তখন সকলে
দেখল যে, সে
বদ্ধ ব্যক্তি ফতেহ্
মুসেলী (রহঃ)। তৎপর সর্রী
সকতীকে ছেড়ে দেওয়া
হল। তিনি ফতেহ্
সুসেলীর সাথেই তাঁর
বাড়ী গেলেন।
কথিত আছে,
লোকে তাঁকে সততা
সম্বন্ধে প্রশ্ন করলে,
তিনি কামারের ভাটিতে
হাত দিয়ে একটি
জ্বলন্ত কয়লা বের
করলেন এবং তা
হাতের তালুতে রেখে
উপস্থিত জনগণকে বললেন,
“এই হলো সততা।”
একদিন তিনি মহাত্মা
হযরত আলী (কঃ) স্বপ্নে
দেখে বললেন, “আমাকে
কিছু উপদেশ প্রদান
করুন”। তিনি (হযরত
আলী) বললেন, “বিরাট
ধনাঢ্যশালী হয়েও আল্লাহ্
পাকের দরবারে পুরষ্কারের
আশায় ভিখারী দরবেশের
সম্মুখে বিনয়াবনত থাকা-
ইহার চাইতে উত্তম
কাজ আমি দেখি
নি”। ফতেহ্ বললেন,
“আরও কিছু উপদেশ
প্রদান করুন”। হযরত
আলী (কঃ) বললেন,
“আল্লাহ্ তাআলার উপর
ভরসা রেখে দরবেশ
লোকের পক্ষে ধনীদের
প্রতি অবহেলা দেখান
উত্তম কাজ।”
ফতেহ্ বলেছেন,
“একদিন আমি এবং
বন্ধুরা মসজিদে বসেছিলাম,
এমন সময় ছেঁড়া
কাপড়-পড়া এক যুবক
এসে আমাকে বলল,
“আপনি জানেন যে,
মুসাফিরেরও একটা হক
আছে। তাই বলছি
আগামীকাল অমুক সময়ে
অমুক গ্রামে আমার
ঘর খুঁজে বের
করবেন। সেখানে আমি
মৃত পড়ে থাকব।
আপনি আমাকে গোসল
দিয়ে এই ছিঁড়া
কাপড় দিয়েই দাফন
করবেন।” তিনি বলেন,
আমি কথা মতো
দ্বিতীয় দিন সেখানে
গিয়ে দেখলাম, সত্যি
সে মারা গেছে।
আমি নিজ হাতে
তাঁকে গোসল দিয়ে
তাঁর পিরহান দিয়েই
তাঁকে দাফন করলাম।
পরে আমি কবর
হতে উঠতে উদ্যত
হলে, সে উঠে
বসল ও আমার
কাপড়ের আচল ধরে
বলল, “হে ফতেহ্ !
যদি আল্লাহ্ পাকের
দরবারে আমার কিছু
মযার্দা মিলে, তবে
আমি তোমার এই
কষ্ট ও দয়ার
প্রতিদান দিব।” তৎপর
বললেন, “ওহে, এরূপ
জীবনযাপন কর, যেন
অনন্ত জীবন লাভ
করতে সক্ষম হও।”
এটা বলেই সে
নীরব হয়ে গেল।
কথিত আছে
যে, একবার তিনি
কাঁদছিলেন, তাঁর দুই
চোখ থেকে রক্তবর্ণ
অশ্রু ঝরছিল। লোকে
জিজ্ঞেস করল, “হযরত,
আপনি কেন সদাসবর্দা
কাঁদেন ?” তিনি বললেন,
“যখন নিজের গোণাহের
কথা চিন্তা হয়,
তখন আমার চোখ
থেকে রক্ত বইতে
থাকে এ ভয়ে
যে, আল্লাহ্ না
করুন, আমার এই
কান্না যেন রিয়ার (লোক-দেখানো) অশ্রুতে
পরিণত না হয়।”
এক ব্যক্তি একদিন
পঞ্চাশ দির্হাম হাতে
নিয়ে ফতেহের দরবারে
এসে বললেন, “হাদীস
শরীফে বর্ণিত আছে
যে, অযাচিত ভাবে
কেহ কাউকে কোন
বস্তু দান করলে
যদি সে তা
গ্রহন না করে
তবে সে যেন
আল্লাহ্র দেওয়া নেয়ামতকে
অগ্রাহ্য করল।” তা
শুনে তিনি মাত্র
এক দিরহাম গ্রহন
করে অবশিষ্টগুলো ফেরত
দিলেন। তিনি বলেছেন,
“আমি এমন ত্রিশজন
লোকের সান্নিধ্য গ্রহন
করেছি, যারা সকলেই
আবদাল (আওলিয়া) ও পরম
ধার্মিক ছিলেন। সকলেই
আমাকে দুনিয়াদার লোকের
সংশ্রয় হতে দূরে
থাকতে ও অল্প
খাদ্য গ্রহন করতে
উপদেশ দিয়েছেন।”
তিনি আরও
বলেছেন, “হে মানবজাতি !
যে রোগীকে পানাহার
বন্ধ করে দেওয়া
হয়, তবে কি
সে মারা যাবে
না ?” সকলে বলল,
“নিশ্চয়ই সে মারা
যাবে।” তিনি বললেন,
“এইভাবে যে ব্যক্তি
নিজ অন্তকরণকে জ্ঞান-বিজ্ঞান
ও সাধকদের পবিত্র
বাণী আলোচনা হতে
বিরত রাখে, তার
অন্তরও মরে যায়।”
তিনি বলেছেন, “একদিন
আমি একজন তারেকে-দুনিয়া
লোককে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
আল্লাহ্ পাকের দিকে
যাওয়ার পথ কোনটি ?”
উত্তরে তিনি বললেন,
“তোমার বিবেকের প্রতি
আফসোস ! আর তুমি
যেদিকে চোখ ফিরাবে,
তিনি ত সেদিকেই
আছেন।” তিনি বলেছেন,
“আহলে মা’রিফাত বা
তত্ত্বজ্ঞ সেই ব্যক্তিকে
বলা যায়, যখন
তিনি কথা বলেন,
আল্লাহ্র পক্ষ থেকেই
বলেন ; যখন তিনি
কাজ করেন, আল্লাহ্র
জন্যই করে থাকেন ;
যখন কিছু চান,
তা আল্লাহ্র কাছেই
চান।”
যে ব্যক্তি
নিজের আশা ও
আকাঙ্খা ছেড়ে আল্লাহ
তাআলাকে গ্রহন করে,
তাঁর উপর আল্লাহ্
তাআলার খুশি প্রকাশ
হয়। যে ব্যক্তি
নিজের নফ্সের (কুপ্রবৃত্তির) বিপক্ষে
আল্লাহ্ তাআলার খুশীকে
গ্রহন করে, তাঁর
প্রতি আল্লাহ্ তাআলার
বন্ধুত্ব প্রকাশ হয়। যে প্রকৃত
আল্লাহ্ ভক্ত সে
অন্য সব কিছু
থেকে বিমুখ হয়।
যখন ফতেহ্ ইন্তিকাল
করলেন, কেহ তাঁকে
স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞেস
করলেন, “আল্লাহ্ তাআলা
আপনার সাথে কেমন
ব্যবহার করেছেন ?” তিনি
বললেন, “আল্লাহ্ তা’আলা
আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“ফতেহ্, তুমি এতো
কান্নাকাটি করতে কেন ?”
আমি উত্তরে বললাম,
“হে আল্লাহ্ , নিজ
পাপের লজ্জার কারণেই
এরকম করতাম।” আল্লাহ্
তাআলা বললেন, “ফতেহ্ ,
আমি কিন্তু তোমার
গোণাহ্ লেখার ভারপ্রাপ্ত
ফেরেশতাকে হুকুম দিয়ে
রেখেছিলাম, যেন তোমার
গোনাহ্ না লেখে
আর এ হুকুম কেবল তোমার
কান্নাকাটির কারণেই করেছিলাম।”